বেপরোয়া ব্যাংক দখল করে দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারী সাইফুল আলম মাসুদের মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি গোপনে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। আর এ কাজে সহযোগিতা করছেন বিএনপির কিছু নেতা।
পতিত স্বৈরাচারী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম দোসর এস আলমের কোনো সম্পত্তি না কেনার বিষয়ে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করার ঘোষণা দেন গর্ভনর। এরপরই নিজেদের অস্থাবর সম্পত্তি গোপনে সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করেছে এস আলম গ্রæপ। এরই মধ্যে রাতের আঁধারে সরিয়ে ফেলা হয়েছে ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি। এ কাজে এস আলমকে সহযোগিতা করেছে বিএনপি কয়েকজন নেতা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায় বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর কর্ণফুলী থানার মইজ্জার টেক এলাকায় এস আলম গ্রæপের চিনির কারখানা প্রাঙ্গণ থেকে একের পর এক গাড়ি বের করে নেয়া হচ্ছে। কয়েকজন এসব গাড়ি বের করার কাজ তদারক করছেন।
জানা গেছে, এস আলমের ফ্যাক্টরিতে থাকা ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি গোপনে সরিয়ে নেয়া হয়। এতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন সুবিধাবাদী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির দুই নেতা। তাদের ব্যক্তিগত গাড়ির চালকেরাও ওইসব গাড়ি সরিয়ে নিতে সাহায্য করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে গাড়িগুলো সরানোর কাজে সহযোগিতা করেন বিএনপি নেতা আবু সুফিয়ানের ড্রাইভার মনসুর।
এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন পটিয়া উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব পিবলু, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম নয়ন।
এর আগে সাইফুল আলম মাসুদের পিএ আকিজ উদ্দিনের খোঁজে এক বিএনপি নেতার বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কোন প্রতিষ্ঠানের নামে কত টাকার ঋণ
এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইটে নিজেদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে এ রকম ৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকটি থেকে বের করা হয়েছে ১৪ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। এ ঋণের সবই নেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখার মাধ্যমে। এর মধ্যে এস আলম রিফাইন সুগার ইন্ডাস্ট্রির নামে ৩ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। সহযোগী প্রতিষ্ঠান চেমন ইস্পাতের নামে ৩ হাজার ৩৩৮ কোটি, এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের নামে ৩ হাজার ২৩২ কোটি, ইনফিনিট স্টিপ ইন্ডাস্ট্রির নামে ২ হাজার ২৮১ কোটি, এস আলম ভেজিটেবল অয়েলের এক হাজার ৫৫১ কোটি, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনের নামে ৯৭৫ কোটি টাকা এবং এস আলম স্টিলের নামে বের করে নেওয়া হয়েছে ৭০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মোট ঋণ রয়েছে ১৭০ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। এর মধ্যে কেবল এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া হয়েছে ১৫০ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া এস আলমের জামাতার প্রতিষ্ঠান ইউনিটেক্স কম্পোজিট মিলকে ২১৫ কোটি টাকা দিয়েছে ব্যাংকটির ওআর নিজাম রোড শাখা। আর ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসের নামে একই শাখা দিয়েছে আরও ২৪০ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন নামে ঋণ বের হলেও সরাসরি এস আলম গ্রুপের সুবিধাভোগী এ রকম প্রতিষ্ঠানকে তারা গ্রুপটির বেনামি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ তালিকায় চট্টগ্রামের মাসুদ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে এ প্রতিষ্ঠানের নামে বের করা হয়েছে ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। মোট ১৭ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ঋণসীমার বিপরীতে বিপুল অঙ্কের এ অর্থ বের করা হয়েছে। মাসুদ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের কর্ণধার আশরাফ হোসেন মাসুদ সমকালকে বলেন, তাঁর নামে ইসলামী ব্যাংকে কোনো ঋণ নেই। একই রকম প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে অন্য কেউ ঋণ নেওয়ারও সুযোগ থাকার কথা নয়। বিষয়টি জানার পর তিনি ইসলামী ব্যাংক থেকে একটি স্টেটমেন্ট নিয়েছেন।
বেনামি প্রতিষ্ঠান আনোয়ারা ফিড মিলের নামে ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম। এ ছাড়া মেডিগ্রীন ইন্টারন্যাশনালের নামে ১ হাজার ১৬২ কোটি, মার্টস বিজনেসের ১ হাজার ১৫৮ কোটি, এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ১ হাজার ১৪৪ কোটি, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের ১ হাজার ১১৪ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্ট প্যালেসের ১ হাজার ১২৩ কোটি, মুরাদ এন্টারপ্রাইজের ১ হাজার ৯২ কোটি, মার্কেট মাস্টার অ্যানালাইজারের ১ হাজার ৯১ কোটি, স্টেইট লাইন ইন্টারন্যাশনালের ১ হাজার ৬০ কোটি, সিলভার ফুডের ১ হাজার ৪৩ কোটি, আইডিয়াল ফ্লাওয়ার মিলসের ১ হাজার ৪২ কোটি, সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টসের ৯১৮ কোটি, নাবিল নাবা ফুডের ৭২৫ কোটি, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ৬৭২ কোটি, টপ টেন ট্রেডিং হাউজের ৪৮৪ কোটি, নাবা ফার্মের ৫৪৫ কোটি, দেশবন্ধু সুগার মিলের ৪২০ কোটি, সুলতান এসোসিয়েটসের ৩৮১ কোটি, সোনালী ট্রেডার্সের ৩৪৭ কোটি, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিলের ৩৯ কোটি এবং নাবিল অটো রাইস মিলের নামে বের করা হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা।
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্যের জন্য এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদকে টেলিফোন করেও পাওয়া যায়নি। ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাও ফোন ধরেননি। ব্যাংকটিকে ‘এস আলম মুক্ত’ করার চলমান আন্দোলনের মধ্যে কয়েকদিন আগে তিনি গা ঢাকা দেওয়ার পর গতকাল অফিসে আসেন।
ব্যাংকটির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষ থেকে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বরাবর একটি চিঠি দিয়ে দ্রুত পর্ষদ পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়। চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ব্যাংকটিতে নামে-বেনামে এস আলম গ্রুপ ৮২ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে। ব্যাংকটিতে একক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ বের করে নিয়েছে। ঋণের বেশির ভাগই পাচার করা হয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ