শেখ হাসিনা বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশকে লোহার মুষ্টিতে শাসন করেছেন। কিন্তু ৫ আগস্ট প্রবল ছাত্র বিক্ষোভের মুখে পড়ে তিনি পদত্যাগ করেন ,অবশেষে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। জনতা প্রধানমন্ত্রীর খালি বাসভবনে ভিড় করে এসে বিজয়োল্লাস করতে থাকে। সেই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন নারী নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধান হিসাবে হাসিনার ১৫বছরের রাজত্বের আকস্মিক পতন ঘটে।
মিডিয়া আউটলেটের রিপোর্ট অনুযায়ী, হাসিনার অফিসে থাকার শেষ ২৪ ঘন্টা সময় সত্যিই মনে রাখার মতো ছিল। ৪আগস্ট সন্ধ্যা ৬ টায়, হাসিনা ক্রমবর্ধমান সরকার বিরোধী বিক্ষোভ দমনের লক্ষ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশব্যাপী কারফিউ জারি করেন। সেই রাতে, সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে অনলাইনে একটি মিটিং করেন এবং তাদের নির্দেশ দেন যে, কারফিউ অমান্য করে রাস্তায় নেমে আসা বেসামরিক লোকদের উপর গুলি চালানো যাবে না। সেনাপ্রধান তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে রিপোর্ট করেন যে তার সৈন্যরা রাজধানী ঢাকায় লকডাউন কার্যকর করতে পারেনি।
৫ আগস্ট সকালে হাসিনাকে কড়া পাহারায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে লুকিয়ে রাখা হয়। বিক্ষোভ দমনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়ে দেন যে তারা পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন । একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা হাসিনাকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে, ওই সিনিয়র কর্মকর্তা হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাকে বলেন প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে রাজি করাতে , তাতেও কোনও লাভ হয়নি। অবশেষে হাসিনার ছেলে, সজীব ওয়াজেদ জয়, একজন ব্যবসায়ী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সরকারের একজন উপদেষ্টা, মাকে ফোন করে রাজি করান। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাসিনা দ্রুত ভারতে প্রবেশের জন্য অস্থায়ী অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন।
হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। সময় ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছিল। তারা অনুমান করেছিল যে জনতার ভিড় ৪৫ মিনিটের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছে যাবে । তিনি এবং রেহানা সরকারী বাসভবনের কাছে একটি পুরানো বিমানবন্দরে এসে সামরিক হেলিকপ্টারে চড়েন। পদত্যাগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে হাসিনা এবং তাঁর বোন ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । প্রায় দুই ঘণ্টা পর, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একটি টেলিভিশন ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং বলেন যে তিনি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন।
ক্ষমতাচ্যুত এই নেত্রী, যিনি শেষ অবধি ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তাঁর জীবন ছিল অস্থিরতায় পূর্ণ। হাসিনা ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের একজন নায়ক, চার বছর পরে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। হাসিনার মা ও ১০ বছর বয়সী ভাইসহ তার পরিবারের ছয় সদস্যকে হত্যা করা হয়। হাসিনা ও রেহানা ওই সময় পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় গণহত্যা থেকে রক্ষা পান। তারা বহু বছর ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন।
১৯৮১ সালে, হাসিনা দেশে ফিরে আসেন এবং তার পিতার প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ (AL) এর সভাপতি হন। ১৯৯০ সালে দেশের গণতন্ত্রীকরণের পর, তিনি ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব দেন।কিন্তু আওয়ামী লীগ অপ্রত্যাশিতভাবে খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কাছে হেরে যায়।
১৯৯৬সালের নির্বাচনে হাসিনা জয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর, হাসিনা নিজের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন, বিরোধী দলকে দমন করেন এবং নিজের শাসনকে দীর্ঘায়িত করেন। সরকারি চাকরির জন্য বিতর্কিত কোটা পদ্ধতির কারণে বাংলাদেশের “আয়রন লেডি” এর আকস্মিক পতন ঘটে। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র একটি দেশ , সেই সময় থেকে সরকারি চাকরিতে ৩০% সংরক্ষণ ছিল ১৯৭১ সালের “মুক্তিযোদ্ধাদের” সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য।
দেশটি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পোশাক শিল্পের হাত ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছে, উচ্চ শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ব্যাপক। আর তাই কোটা ব্যবস্থাকে অন্যায্য আখ্যা দিয়ে তা বাতিলের দাবিতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায় শিক্ষার্থীরা।
ছয় বছর আগেও প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানিয়েছিলেন। হাসিনা রাজি হন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত কোটা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু চলতি বছরের ৫ জুন কোটা প্রথা বিলুপ্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্ট নীতিগত সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে কোটা পুনর্বহাল করে ।
আদালতের রায়ের পরে আবারও বিক্ষোভ শুরু হয়।সরকার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল, কিন্তু ছাত্রদের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে সরকারের উপর। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে এই রায় রাজনৈতিক চাপের ফলে হয়েছে। হাসিনা দাবি করেন যে বিএনপির মতো বিরোধী দল পর্দার আড়ালে থেকে ছাত্রদের উস্কাচ্ছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে ক্র্যাক ডাউন করার নির্দেশ দিয়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন হাসিনা বিক্ষোভকারীদের “রাজাকার” বলে অভিহিত করেন।
চাকরিতে কোটা সিস্টেম নিয়ে যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল তা সরকারকে উৎখাত করার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ২১শে জুলাই সুপ্রিম কোর্ট সরকারি চাকরিতে বেশিরভাগ কোটা বাতিল করে দেয়, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
নিরাপত্তা বাহিনী এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে উভয় পক্ষের অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে, পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। ১৬ অগাস্ট প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সরকার পতনের পর ছাত্র বিক্ষোভ এবং পরবর্তী অশান্তিতে প্রায় ৬৫০ জন মারা গেছেন ।হাসিনাকে বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে তার নৃশংস প্রতিক্রিয়ার মূল্য চোকাতে হয়েছে । হাসিনা এমন একজন নারী যাঁকে ৪৩বছর আগে, স্বাধীনতার নায়কের কন্যা হিসাবে আনন্দের সাথে স্বাগত জানিয়েছিল গোটা দেশ । এখন তিনিই দেশ থেকে নির্বাসিত।
বড় প্রশ্ন হল হাসিনা, যিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে নেতৃত্ব দেবেন বলে আশা করা হয়েছিল, তিনি কেন একজন নির্মম কর্তৃত্ববাদী শাসক হয়ে উঠলেন। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপিং ইকোনমিসের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মায়ুমি মুরায়ামা বলছেন- ‘১৯৯৬ সালে যখন তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন হাসিনাকে একজন কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিবিদ বলে আমার মনে হয়নি।
দু বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে থাকার পর হাসিনা ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতায় ফিরে আসেন তখন তাঁর কর্তৃত্ববাদী আচরণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। প্রথমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে হাসিনা সংবিধান সংশোধন করেন। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য একটি সিস্টেমের অভাব ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ স্থানান্তরকে বাধা দেয় এবং তার কর্তৃত্ববাদকে কায়েম করার পথ প্রশস্ত করে দেয়।
তিনি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করান, বিএনপিকে দুর্বল করে দিতে কোনো কসুর বাকি রাখেননি হাসিনা। দেশে এমন একটি পরিবেশ তৈরী করেছিলেন যেখানে সরকারের সমালোচনা ছিল অপরাধের সমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গণমাধ্যমে বাকস্বাধীনতার অধিকারকে খর্ব করা হয়।
আ.লীগের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য বাড়তে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং প্রশাসনের সমালোচকরা হয়রানির শিকার হতে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির কোটা নিয়ে বিক্ষোভ ছিল হাসিনারকর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রাথমিক সুবিধাভোগী আ.লীগকে সমর্থনকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
ভারতীয় সংবাদপত্র দ্য হিন্দু -র দাবি , ‘হাসিনা তার সেরা উপদেষ্টাদের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত, শুধুমাত্র তার বোন রেহানাকেই বিশ্বাস করতেন’। মুরায়ামার পর্যবেক্ষণ -‘ না’ শুনতে পছন্দ করতেন না হাসিনা , তাই প্রধানমন্ত্রী প্রতিবাদী ছাত্রদের যুক্তি এবং উপলব্ধি সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি। ‘
প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন, যার কোনো প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না, তিনি সঙ্কটের পরবর্তী পরিস্থিতি দ্রুত মোকাবেলায় জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাথে সহযোগিতা করেছিলেন। বিরোধী দল, নাগরিক সংগঠন এবং ছাত্র গোষ্ঠীর সাথে পরামর্শ করার পর, তিনি আ.লীগ-অধ্যুষিত সংসদ ভেঙে দেন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন। প্রাক্তন কূটনীতিক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মী এবং ছাত্র প্রতিনিধি সহ ১৬ জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে গঠিত, অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশে স্থিতিশীলতা আনার এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচন সংঘটিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে বিভক্ত, প্রায় ৩০% করে দুটি প্রধান দল, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি -এর সমর্থক , বাকি ৪০% ছোট দলগুলিকে সমর্থন করে।গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সম্ভবত রাজনৈতিক গতিশীলতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করবে। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে যদি বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তারা আ.লীগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, “বাংলাদেশের জনগণ এতদিন যে বাইনারি রাজনীতি দেখে এসেছে তা তারা আর মেনে নিতে চাইছে না। এই অল্প সময়ের মধ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষের উদ্ভব এবং মানুষের জন্য সত্যিকারের বিকল্প প্রদান কঠিন হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের হয়ে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ইউনূস তার বক্তপব্যে বলেছিলেন, ‘ বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছে। ‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হাসিনার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শেষ পর্যন্ত সামরিক বা কর্তৃত্ববাদী শাসনমুক্ত একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাস্তবায়িত হবে কিনা।জাপানের মতো শুধুমাত্র নেতৃস্থানীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলিই নয় — বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সাহায্য দাতা — মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের পাশাপাশি , গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশ যেখানে কর্তৃত্ববাদ এবং গণতন্ত্র উভয়ই বিদ্যমান , তারাও বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নয়ের উপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখবে।
আপনার মতামত জানানঃ