দৈনিক প্রায় ১৭ হাজার যানবাহন চলবে বলা হলেও চলে সর্বোচ্চ ৩ হাজার। দৈনিক টোল আদায় হয় দেড় লাখ টাকা, পাশে শাহ আমানত সেতুতে হয় ২০ লাখ টাকা।
প্রসঙ্গত, প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল এখন ঘাড়ের ওপর বোঝা হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ সময় টানেল থাকে ফাঁকা। নেই যানবাহনের চাপ। নির্মাণের আগে যানবাহন চলাচল নিয়ে জরিপে বলা হয়েছিল দৈনিক প্রায় ১৭ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। কিন্তু এখন সর্বোচ্চ দৈনিক ৩ হাজার যানবাহন চলাচল করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে টানেল থেকে দৈনিক প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো টোল আদায় হচ্ছে। অথচ ৫৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু থেকে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা টোল আদায় হচ্ছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করায় ও পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় স্বপ্নের টানেল এখন জাতির জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে।
নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাশে কাফকো ও সিইউএফএলের মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা এলাকায় সংযুক্ত হয়েছে টানেলটি। টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। টানেল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা টাকা। তার মধ্যে চীনা এক্সিম ব্যাংক ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা আর বাংলাদেশ সরকার ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা অর্থায়ন করেছে। চীনা এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে এই ঋণ দিয়েছে। আগামী বছর থেকে চায়নার ঋণ পরিশোধ শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
টানেলের সহকারী প্রকৌশলী (টোল ও ট্রাফিক) তানভির রিফাত বলেন, ‘টানেল চালুর পর গত ৮ মাসে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা টোল আদায় হয়েছে। এখানে চলাচলকারী যানবাহনের মধ্যে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসের সংখ্যাই বেশি। অন্যান্য ভারী যানবাহন তেমন চলছে না।’
২০২৩ সালে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ২৯ নভেম্বর থেকে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। টানেল নির্মাণের আগে সম্ভাব্যতা জরিপের সময় টানেল চালু হওয়ার পর দৈনিক ১৭ হাজার ২৬০টি যানবাহন চলাচল করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে ২০২৫ সালে বেড়ে দৈনিক ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে দৈনিক মাত্র ৩ হাজারের মতো যানবাহন চলছে বলে টোল আদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত ২৯ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত আট মাসে প্রায় ৩১ কোটি টাকা টোল বাবদ রাজস্ব আদায় হয়েছে। টোল দিয়ে পণ্যবাহী কোনো গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও কিছু বাস চলাচল করছে। ফলে আশানুরূপ টোল আদায় হচ্ছে না। চালু হওয়ার পর মানুষ টানেল দেখার জন্য প্রাইভেট কার মাইক্রোবাস নিয়ে যাতায়াত করেছে। ফলে শুরুতে মাস দুয়েক বেশ ভালো টোল আদায় হয়েছে। এখন অধিকাংশ সময় টানেল ফাঁকা থাকে। যানবাহনের চাপ নেই। ফলে টানেলের আনোয়ারা প্রান্তের দীর্ঘ সংযোগ সড়কটিও প্রায় সময় ফাঁকা পড়ে থাকে।
টানেল নির্মাণের সময় স্বপ্ন ছিল চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে উঠবে। টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে ব্যাপক হারে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তখন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতা, রাজনৈতিক নেতারা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যাপক হারে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে বলেছিলেন। অথচ দেশে বর্তমানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের যে স্থবিরতা বিরাজ করছে তা কবে কাটবে তা বলা যাচ্ছে না। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে নতুন কোনো বিদেশি বিনিয়োগ হয়নি। দেশীয় বিনিয়োগেও স্থবিরতা বিরাজ করছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ-সংকট, জায়গার সংকটে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতা মো. নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না। টানেলটি কিছু দিন পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার হয়েছিল। টানেল সংযুক্ত সড়কটি চন্দনাইশ কক্সবাজার সড়কের সঙ্গে যুক্ত করা গেলে যানবাহন চলাচল বাড়তে পারে। তবে এখন অর্থনৈতিক আয় বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আপাতত টানেলের প্রয়োজন ছিল না বলে মনে হলেও আগামীতে ১০০ বছরের টার্গেট করে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে অনেক খালি জায়গা পড়ে রয়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী জমি কিনে রেখেছেন। গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। তখন টানেলের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যাবে।’
টানেলটি নির্মিত হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ প্রান্তে। টানেলের অবস্থানগত কারণে যানবাহন চলাচল হচ্ছে না। অথচ কর্ণফুলীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতু থেকে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা টোল আদায় হচ্ছে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া বলেন, টানেলের উপযোগী সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। পরিবহন ব্যবস্থা না করে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। টানেল নির্মাণের এক কিলোমিটারের খরচ দিয়ে পুরো চট্টগ্রাম নগরীতে পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হতো। গাড়ি না চললেও টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, নিরাপত্তা ব্যয় করতে হচ্ছে। বিষাক্ত গ্যাস বের করে অক্সিজেন ঢুকাতে হচ্ছে। দূরদর্শিতার অভাবে টানেল নির্মাণের বিদেশি ঋণ এখন ঘাড়ের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
আপনার মতামত জানানঃ