২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল পাঁচটায় নির্দেশ পৌঁছালো। ওই দিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাশ্যুট রেজিমেন্টের অগ্রবর্তী দলের দায়িত্বে ছিলেন মেজর কমলদীপ সিং সাধু। মাত্রই সক্রিয় করা হয়েছে জরুরী সংকেত। সম্মুখসারির একাধিক প্যারাট্রুপার দলকে মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। চব্বিশ ঘন্টাই জরুরি মোতায়েনের জন্য পুরো এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যধারী একটি স্ট্রাইক ফোর্স প্রস্তুত রাখে ভারত। এদেরকে ভারতের ক্ষমতা প্রক্ষেপণের অগ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য করা হয়।
আগের রাতেই অনুরূপ একটি জরুরি সংকেত সক্রিয় হয়ে পরে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু ফের যখন সংকেত সক্রিয় হলো এবং “পাঁচ থেকে ছয়টি” আইএল-৭৬ ও এএন-৩২ বিমান প্রস্তুত রাখার নির্দেশ এলো, সাধু বুঝতে পারলেন বড় কিছু ঘটতে চলেছে।
আড়াই ঘন্টা পর এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় প্যারাট্রুপার পশ্চিমবঙ্গের কলাইকুণ্ডা বিমানঘাঁটিতে অবস্থান নেয়। সেখানেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত আসার পর সাধুর অধিনায়ক কিছু নির্দেশনা দিলেন।
বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিডিআর-এর সদস্যরা বিদ্রোহ করেছে। সেনাবাহিনী থেকে আগত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে হত্যা করছে। সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন, তিনি হুমকির মুখে পড়েছেন। তিনি আর সেনাবাহিনীর সমর্থনের উপর নির্ভর করতে পারছেন না।
“তিনি ভারতের কাছে সাহায্য চেয়েছেন…এবং সেই জন্যই আমরা বিমানঘাঁটিতে অবস্থান নিয়েছিলাম,” নতুন নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, স্মৃতি হাতড়ে জানালেন সাধু। “আর ঢাকায় অবতরণের পর যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।”
নয়াদিল্লি ঢাকায় ভারতীয় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। যদি সহিংসতা বৃদ্ধি পায় তবে এই কূটনীতিকরাও হামলার মুখে পড়তে পারেন।
ঠিক একই মুহূর্তে সেনা কর্মকর্তাদের উপর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞটি চলছিল। হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার পরপরই হাসিনা তার নিকটতম মিত্র নয়াদিল্লির শীর্ষ কংগ্রেস নেতা, সদ্য নিযুক্ত অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে ফোন করলেন।
ঘটনা শোনার পর, মুখার্জি “সাড়া দেওয়া”র প্রতিশ্রুতি দিলেন। ঢাকা থেকে “সাহায্যের অনুরোধে”র প্রেক্ষিতে প্যারাট্রুপার মোতায়েনের এন্তেজাম করা হলো। পাশাপাশি, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শিবশঙ্কর মেনন হাসিনার পক্ষে সমর্থন নিশ্চিতের জন্য মার্কিন, ব্রিটিশ, জাপান ও চীনা দূতদের সঙ্গে জরুরী ভিত্তিতে যোগাযোগ শুরু করলেন।
কলাইকুণ্ডার পাশাপাশি জরহাট ও আগরতলাতেও প্যারাট্রুপার প্রস্তুত রাখা হল। নির্দেশ এলেই ভারতীয় সেনারা তিনদিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতো।
উদ্দেশ্য ছিল জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (বর্তমানে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) ও তেজগাঁও বিমানবন্দর দখলে নেওয়া। পরবর্তীতে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হাসিনাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হতো।
অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেড কমান্ডার সক্রিয় যুদ্ধের সময় ব্যবহার্য “প্রথম ধাপে”র গোলাবারুদ বিতরণ শুরু করলেন। “অত্যন্ত অস্বাভাবিক” এই কাজ থেকে উদ্ভুত পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করা যায়।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা নিয়ে একটি উদ্বেগ ছিল। যদি বাংলাদেশের জেনারেলরা হাসিনার বিরুদ্ধে যান, তারা ভারতীয় সৈন্যদের প্রতিরোধ করবে। সাধু জানালেন যে “যদি তেমনটা হতো, তাহলে পূর্বভারতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পুরো একটা কর্পস রয়েছে,” সেখান থেকে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানো হতো।
ভারতীয় সেনাবাহিনী ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করার দ্বারপ্রান্তে ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত আদেশটি শেষ পর্যন্ত আসেনি। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী তখন ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার (২০০৭–১০)। বাংলাদেশ তার পিতৃপুরুষের আদিবাস। হাসিনাকে তিনি সম্মান করে “আপা” বলে ডাকতেন। তিনি বলেন, “আমরা কিছু বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রেখেছিলাম বটে। হাসিনাকে জানিয়েছিলাম যে আমরা তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।”
কিন্তু কেন? কারণ ভারত “জানতো না পরিস্থিতি কতদূর গড়াবে।” ওদিকে ঢাকায় বিডিআর বিদ্রোহীরা তাদের মহাপরিচালক ও তার স্ত্রীকে পিলখানা সদরদপ্তরে হত্যা করে। এভাবে বাংলাদেশজুড়েই বিভিন্ন স্থানে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একই রকম হামলার সূত্রপাত হয়।
তখন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উদ্দিন আহমেদের উপর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকে। কিন্তু তিনি যদি এমন পদক্ষেপ নিতেন তবে তা থেকে একটি রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো এবং অস্থিতিশীলতা আরও বেড়ে যেত। একই সঙ্গে তা হাসিনার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলত। বিদ্রোহীদের অথবা বিক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তাদের হাতে তিনি নিহত হতে পারতেন। কিংবা একটি সামরিক অভ্যুত্থানে উৎখাত হতে পারতেন।
২০০৭ সালে তিনি একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। একই ঘটনা আবার ঘটতে পারতো। ভারত সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি। তাই ভারত যা প্রয়োজন মনে করেছে তা-ই করেছে। ভারত তখন সেনাবাহিনী প্রধান মঈন ইউ আহমেদকে বলপ্রয়োগ না করার জন্য হুমকি দেয়।
“যারা ওই সময় ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল তারা আমাকে বলেছিল যে জেনারেল মইনকে বলা হয়েছিল বলপ্রয়োগ না করতে। অন্যথায় [ভারতীয়] প্যারাট্রুপাররা এক ঘন্টার মধ্যে ঢাকায় নেমে পড়বে,” বলেন তৌহিদ হোসেন, যিনি তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন।
ভারতের ওই হুমকি কাগুজে ছিল না। “এ ঘটনাগুলো কিন্তু আসলেই ঘটছিল … প্রয়োজন হলে আমরা হস্তক্ষেপ করতাম,” আমাকে এটা নিশ্চিত করেন ভারতীয় এক শীর্ষ কর্মকর্তা যিনি পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত প্যারাট্রুপার মোতায়েনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি কারণ জেনারেল মঈন শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যান। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ হোসেন ঘোষণা দিলেন, “প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন যে উদ্ভুত সংকটটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা উচিত। সমস্যাটির সমাধান সেভাবেই করা হয়েছে।”
ওই সময় বান্দরবানে একটি সেনা ব্রিগেডের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, “তার (মঈনের) আসলে আদেশ দেওয়া উচিত ছিল এবং সেনাবাহিনীকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল।”
পরবর্তী দুই দিনের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা স্থানীয় বিডিআর ইউনিটে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। রহমানের মতে, “এটি কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। একটি সামরিক সংকট হিসেবে সেনাবাহিনীকে নির্ধারিত নিয়মাবলীর মধ্যে থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা আর করা হয়নি।”
২০০৯ সালে ভারত যদি বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতো, তবে তা উপমহাদেশের ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দিতো। ভারতের হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্তও কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
হাসিনাকে রক্ষার জন্য বলপ্রয়োগের হুমকি দেওয়ার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এমনভাবে দুর্বল করলো যে তা হাসিনাকে পরবর্তীতে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মুক্তহস্তে দমনপীড়নের সুযোগ করে দেয়। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে হাসিনা প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর কোনো প্রকার রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত হলেন — সম্পূর্ণ ভারতের কৃপায়।
নয়াদিল্লীর এমন প্রতিক্রিয়ার পেছনে কী কারণ ছিল? ভারতের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানতো। পাশাপাশি, ভারতের বিরুদ্ধে আধিপত্যবাদের যে দূর্নাম, তা আরও পোক্ত হতো।
ভারতের হস্তক্ষেপে হাসিনার জীবন বাঁচতো ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে ভারতের “আজ্ঞাবহ” হিসেবে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে, সেটাই প্রমাণ হতো। হাসিনার রাজনৈতিক জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যেতো।
ভারত উল্টো দেখলো যে হাসিনা বরং বিডিআর বিদ্রোহটিকে দেখলেন তার সরকারকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত হিসেবে। “তিনি নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তবে তিনি এ-ও বুঝতে পেরেছিলেন যে বিদ্রোহকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি স্বজন ও সহকর্মী হারানো বিক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলেন,” বলেন চক্রবর্তী।
ওই সময় সেনা কর্মকর্তাদের হাতে অপমানিত ও হেয় হওয়ার পরেও হাসিনা নিজের অবস্থানে অটল থাকলেন। তিনি তাদের কথা শুনলেন ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলেন। “তিনি যা করেছিলেন তা সঠিক ছিল, কারণ এর একটি শান্তিপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল,” যুক্তি দেন হোসেন।
বিদ্রোহের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটলো সেনাবাহিনী যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের “তত্ত্বাবধানে” ট্যাঙ্ক নিয়ে পিলখানায় প্রবেশ করল। প্রায় ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হল। বিদ্রোহের সমাপ্তি ও মইনের সংযম প্রদর্শন হাসিনাকে ক্ষমতা সুসংহত করার সুযোগ করে দিল। যেসব কর্মকর্তা হাসিনার সঙ্গে দূর্ব্যবহার করেছিলেন তারা সবাই একে একে চাকরি হারালেন। বিডিআর ভেঙ্গে দেওয়া হল।
“তিনি খুব বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। একজন সাহসী, লৌহমানবীর মতো,” স্মরণ করে বলেন পিনাক চক্রবর্তী।
কিন্তু ভারতকে বাংলাদেশে বলপ্রয়োগ করার মতো সিদ্ধান্তে আসতে হয়েছিল — এ থেকে মূলত পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে ভারতের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়।
বিডিআর বিদ্রোহের সময় ভারতের এই অনিরাপত্তাবোধের কারণ অনুসন্ধানে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ২০০১-০৬ সালের বিএনপি-জামায়াত আমল ও ২৬ নভেম্বর মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার সময়কার ঘটনাবলীতে। মুম্বাই হামলার ক্ষত তখনও শুকায়নি। নয়াদিল্লি তাই বিডিআর বিদ্রোহটিকে পাকিস্তান-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং একটি জাতীয় নিরাপত্তাজনিত হুমকি হিসেবে দেখেছিল। বিডিআরের সাধারণ সদস্যদের ক্ষোভের কারণ অনুসন্ধান ছাড়াও ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এই বিদ্রোহের আদর্শিক পরিকাঠামো নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
চক্রবর্তীর ভাষ্য অনুযায়ী, “বিএনপি-জামায়াতের শাসনকালে অনেক জামায়াত-কর্মী বিডিআরের সাধারণ সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল। তাদেরকে দৃশ্যত পাকিস্তান ব্যবহার করেছিল।” ২০০৪–০৭ এর আশা জাগানো সংলাপের পর পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর। এমন পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি চায়নি ঢাকায় অস্থিতিশীলতা তৈরি হোক কিংবা ভারতবিরোধী কোনো সরকারের উত্থান ঘটুক।
যদিও বিডিআর বিদ্রোহ ও বিদ্রোহের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংযোগ প্রচুর গুজবের জন্ম দিয়েছিল, তবে নয়াদিল্লির স্বার্থের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। একদিকে মে মাসে লোকসভা নির্বাচন ঘনিয়ে আসছিল। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রবেশ করছিল। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এই সময়টাতে হাসিনার ক্ষমতা হারানো মেনে নিতে পারতেন না। মেনন যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছিলেন যে হাসিনার কিছু হলে জামায়াত ও হরকাত-উল জিহাদ-আল ইসলামী (হুজি-বি) বাংলাদেশ থেকে ভারতে হামলা চালাবে।
এই বিষয়ে বিএনপি সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রসঙ্গ টানা জরুরী। চৌধুরী একজন প্রভাবশালী জাহাজ ব্যবসায়ী ছিলেন। চট্টগ্রাম বন্দরের বাণিজ্য কার্যক্রমে তার প্রবেশাধিকার ছিল। পাশাপাশি তিনি ছিলেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। ১৯৭১ সাল থেকেই তিনি আইএসআই-এর এজেন্ট হিসেবে বিবেচিত হতেন। বিদ্রোহের শুরুতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সিএনএন নিউজ নেটওয়ার্কের ভারতীয় শাখা অভিযোগ করে যে চৌধুরী পাকিস্তানের পক্ষে বিদ্রোহ উস্কে দিচ্ছেন।
ক্রুদ্ধ চৌধুরী চ্যানেলটিকে মামলা করার হুমকি দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন যে খালেদা জিয়া হাসিনাকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করবেন না। বিদ্রোহের এক সপ্তাহ পর ৮ মার্চ তিনি পশ্চিমা কূটনীতিকদের সগৌরবে জানান যে পরিস্থিতি ভুলভাবে মোকাবেলার কারণে জ্যেষ্ঠ ও মধ্যমসারির কর্মকর্তাদের মধ্যে হাসিনার বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। চৌধুরীর মতে এদের অধিকাংশ বিএনপিকে সমর্থন করে।
বিদ্রোহকে ঘিরে চৌধুরীর ভূমিকা এবং অনুসন্ধান শুরু হওয়ার আগেই সিএনএন ইন্ডিয়া তাকে দোষারোপ করা একটি জটিল ইতিহাসের ইঙ্গিত দেয়। বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পর, পানি ভাগাভাগি ও অর্থনৈতিক সংযোগের মতো বিষয়গুলিতে আনুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে শীতলতা তৈরি হয় — চৌধুরীর এতে ভূমিকা ছিল।
২০০১ সালে খালেদা জিয়ার নির্বাচন জয়ের পর অভিনন্দন জানানো প্রথম বিদেশী গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র। খালেদা সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহ পরে ২৬-২৭ অক্টোবর মিশ্র ঢাকায় যান। কিন্তু এবার দেখা গেল যে খালেদার পুত্র ছেলে তারেক রহমান সরকারি ও দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ক্ষেত্রে তার মায়ের চেয়ে বেশি প্রভাব রাখছেন। তারেকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা মাথুরের (একজন ভারতীয় গোয়েন্দা) মতে, “তিনি ভারতের প্রতি আন্তরিক ছিলেন এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উন্নয়নের পথে নিজের ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্বকে সামনে আসতে দেননি।”
কিন্তু এতেও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেনি। উত্তর-পূর্ব বিদ্রোহীদের সমর্থন বন্ধ করা এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা — ভারতের এই দু’টি রেড লাইনই বিএনপি আমলে অতিক্রম করা হয়েছিল। মিশ্র ঢাকাকে দিল্লীর এই উদ্বেগগুলো অবহিত করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পরপরই ভোলা ও যশোর জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ শাসক দল বিএনপি ও জামায়াতের আক্রমণের শিকার হন। ঐ অঞ্চলের হিন্দুরা হত্যা ও গণধর্ষণের শিকার হন। তাদের সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়, অনেকে বাস্তুচ্যুত হন।
একইভাবে ওই সময়টাতেই উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনে “জোয়ার” দেখা যায়। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল তা প্রকাশ্যে আসে। সেদিন চট্টগ্রামে অস্ত্র ভর্তি দশটি ট্রাক ধরা পড়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম অস্ত্র চালানটির গন্তব্য ছিল উত্তর-পূর্ব ভারত। চালান পাঠানোর অভিযান নিয়ন্ত্রণ করছিলেন ঢাকায় সেফ হাউসে অবস্থানকারী ইউএলএফএ-আই প্রধান পরেশ বড়ুয়া।
ওই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র প্রথমে একটি বড় জাহাজ থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণতম স্থান সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ও তারপরে সরকার-অধিকৃত চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের ডকে স্থানান্তর করা হয়।
সেন্ট মার্টিনের জাহাজটির মালিক অন্য কেউ ছিলেন না — ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, যিনি ভারতের মতে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করছিলেন তারেকের অনুমোদন নিয়ে। চক্রবর্তীর ভাষ্যমতে, “খালেদা জিয়ার ওই অতি-উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুত্র অনেক ক্ষমতা দখল করে ফেলেছিল। এরপর অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠাতে শুরু করে।”
এর পরপরই মার্কিন সংস্থাগুলির সঙ্গে সমন্বয় করে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত ১৪৮টি বিদ্রোহী শিবিরের একটি তালিকা ঢাকাকে সরবরাহ করে। চক্রবর্তী বলেন, “তারা আমাদের জবাব দিত যে না, না, আমরা যাচাই করেছি এবং এই শিবিরগুলো সেখানে নেই … বিষয়টিকে একটা ইঁদুর–বিড়াল খেলায় পরিণত করা হয়েছিল। সূত্র: নেত্র নিউজ।
আপনার মতামত জানানঃ