বার্তা সংস্থা এএফপি এক রিপোর্টে বলেছে, দেশ জুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া এবং আবার তা চালু হওয়ার পর লাখ লাখ বাংলাদেশি অনলাইনে ফিরেছেন। তারা নিজেদের ঘরের ভেতর বন্দি করে রেখেছিলেন। এ সময়ে তারা যেসব কথা শুধু শুনেছেন, তাদের অনেকে পুলিশের সেই ভয়াবহ দমনপীড়নের দৃশ্য দেখে স্তব্ধ। গত মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০৬ জন নিহত হন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতার মেয়াদে সরকারি চাকরিতে বিধির বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলনে এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ অস্থিরতা। নিহতদের মধ্যে কিছু পথচারী এবং কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আছেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, নিহতদের বেশির ভাগই মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করার নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। ১১ দিন পর্যন্ত ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। এ জন্য নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যকার সংঘর্ষের ফুটেজ সংবাদ ভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যমগুলোতে ছিল ব্যাপকভাবে অনুপস্থিত।
এরপর সচল করা হয়েছে ইন্টারনেট মোবাইল নেটওয়ার্ক। এর আগে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছিলেন খুব কম মানুষই। যদিও এই অস্থিরতা শান্ত হয়েছে। কিছু তরতাজা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করছে পুলিশ। ফলে এই সরকারের বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে। একজন যুবককে এক পুলিশ কর্মকর্তা গুলি করেছেন। তাকে অন্য একজন টেনে নিরাপদে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এমন একটি শর্ট ক্লিপের জবাবে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারী লিখেছেন, আমাদের ভাই ও বোনদের এভাবে কেমন করে হত্যা করছে পুলিশ?
ওই ফুটেজটি রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা যাত্রাবাড়ীরÑ বিষয়টি নিশ্চিত হতে সক্ষম হয়েছে এএফপি। সেখানে তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী ভিডিওটি শনাক্ত করতে সহায়তা করেছেন। তারা সবাই প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ে নিজেদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ২০শে জুলাই অস্থিরতার চরম পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করার জন্য সরকার দেশ জুড়ে কারফিউ ঘোষণা দিয়ে সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেয়। এরপরই ওই ঘটনা ঘটে। তিন প্রত্যক্ষদর্শীর একজন বলেন, ভিডিওর ওই ব্যক্তি ১৮ বছর বয়সী ইমাম হোসেন তায়েম। তাকে অভিযুক্ত করেছে পুলিশ। কিন্তু গুলি করার আগে সে প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেয়নি।
ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, মাটিতে পড়ে যায় তায়েম। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ঘটনাস্থল থেকে দু’জন মানুষ সরে যান। কিন্তু একজন যুবক ফিরে গিয়ে তার বন্ধুকে টেনে সরানোর চেষ্টা করেন। তায়েমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। তার পিতা মইনুল হোসেন বলেন, পরের দিনই তিনি মারা যান। তায়েমের বড়ভাই তুহিন বলেন, তায়েম কোনো বিক্ষোভকারী ছিল না। কারফিউ’র বিরতির সময় সে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করছিল। ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার পর তায়েমের এই ভিডিও দেখেছেন কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ। ৬০ সেকেন্ডের এই ভিডিওক্লিপের শেয়ার হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ সহ অন্যান্য প্ল্যাটফরমে।
কিছু দিন আগে রামপুরা থেকে ধারণ করা আরেকটি ভিডিও যাচাই করেছে এএফপি। এতে দেখা যায়, একটি নির্মাণাধীন ভবনে পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টাকারী এক যুবককে খুব কাছ থেকে গুলি করছে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, ওই ব্যক্তি ভবনটিতে উঠে পালাতে চেয়েছিলেন। ফেসবুকে এই ভিডিও ক্লিপটি দেখেছেন কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ। ফেসবুকের একজন ব্যবহারকারী এটা দেখে কমেন্টে লিখেছেন, ‘এই ভিডিও দেখে কতোবার কেঁদেছি জানি না। আমি এখনো কাঁদছি। একটি স্বাধীন দেশে এটা হতে পারে না।’
১৫ বছরের শাসনকালে বিরোধী দলগুলোকে একপেশে করে ফেলা এবং নিষ্ঠুরভাবে ভিন্নমতকে দমন করার অভিযোগে সরকারকে দায়ী করেছে অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর প্রেস ফ্রিডম সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫ নম্বরে। এই অবস্থান রাশিয়ার নিচে এবং সৌদি আরবের উপরে। গত মাসের অস্থিরতার সময়ে প্রায় দুই কোটি মানুষের এই মেগাসিটির মানুষ তাদের ঘরের ভেতর থেকে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন।
কিন্তু টেলিভিশনে তা ভয়াবহভাবে সেন্সর করার ফলে তা ছিল অনুপস্থিত। বিশৃঙ্খলাকারীদের ওপর পুলিশি জবাব দেখানো হয়নি বললেই চলে। পক্ষান্তরে তারা প্রচার করেছে বিক্ষোভকারীদের দেয়া অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের দৃশ্য। ছবি, ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দেখতে পেয়েছে যে, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অনেক স্থানে ‘বেআইনি’ শক্তি প্রয়োগ করেছে পুলিশ।
পুলিশি অভিযানের নিন্দা জানিয়েছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল। একই সঙ্গে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিচার করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এক বিবৃতিতে জোসেপ বোরেল বলেন, বিক্ষোভকারী ও অন্যদের বিরুদ্ধে আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত এবং প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনেক ঘটনার পূর্ণাঙ্গ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তবে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের কথা সপ্তাহান্তে প্রত্যাখ্যান করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেছেন, নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা চরম ধৈর্য দেখিয়েছেন। সরকারি ভবনগুলোতে হামলা ঠেকাতে প্রয়োজন হয়েছে যখন, শুধু তখনই গুলি করেছে। যখন তারা দেখেছেন সম্পত্তি সুরক্ষিত করা যাচ্ছে না, তখন গুলি করতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ।
আপনার মতামত জানানঃ