ঈদের পরপরই নববর্ষ। লম্বা ছুটি বাংলাদেশে। পাহাড় থেকে সমতল- সব জায়গায় রয়েছে আনন্দ আয়োজন। এগুলো ঘিরে সচল সার্বিক অর্থনীতি। কিন্তু সব উৎসব সবার হয়েছে কী?
আর আক্ষরিকভাবেই যেখানে রং মাখার ব্যাপার থাকে, সেটা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দোল উৎসব। হালে অবশ্য এটা ‘হোলি’ নামেই বেশি পরিচিত। অনেককাল ধরেই ঢাকার শাঁখারীবাজারে দোলের দিন রং মাখামাখি করে আনন্দ ভাগাভাগির ব্যাপার থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদেও এমন আয়োজন ছিল এবার।
ধর্ম যার যার, উৎসব সবার- এমন প্রতিপাদ্যে সম্প্রীতির আহ্বান থাকলেও দেশে ধর্মীয় উৎসবগুলো সর্বজনীন হতে পেরেছে কিনা এ নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।
তিনি বললেন, ‘‘ঈদ একটা সম্প্রদায়ের। অন্যদিকে নববর্ষ হচ্ছে সর্বজনীন। এটা একটা তফাৎ। নববর্ষ সব ধর্ম-বর্ণের। যে কারণে বাংলাদেশে যুদ্ধ হয়েছিল, সেটার একটা প্রতীক হচ্ছে নববর্ষ। আর ঈদ হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় উৎসব। বাংলাদেশে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব এটা।”
তিনি আরো যোগ করেন, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে দুর্গাপূজায় সব সম্প্রদায়ের মানুষ যোগ দিয়ে থাকে, পূজা না করলেও উৎসবে শামিল হয়। ঈদ শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই বাংলাদেশে একমাত্র সেকুলার উৎসব নববর্ষ।
এবার ঈদের আবহের মধ্যেই পয়লা বৈশাখ- এর প্রভাব সম্পর্কে লেখক-গবেষক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘‘নববর্ষে উদযাপনের আধিক্য এখন শহরে দেখা যায়। এবার ঈদের ছুটির কারণে মধ্যবিত্তরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। তাই নববর্ষ উদযাপন হবে ঠিকই, তবে তা কিছুটা নিষ্প্রভ থাকবে। এছাড়া ঈদের উৎসব তিন দিন ধরে থাকে। এর মধ্যেই নববর্ষ চলে আসায় এবার ঈদের অর্থনীতি যতটা প্রবল, নববর্ষের অর্থনীতি ততটা প্রবল থাকছে না।”
অন্যদিকে কৃষি অর্থনীতি বাংলা নববর্ষের সূচনা থেকেই জড়িয়ে আছে। কারণ, কৃষিকাজের সুবিধার জন্য বাংলা অঞ্চলে সৌরবর্ষ প্রবর্তন করেন মোগল সম্রাট আকবর। শুরুতে বঙ্গাব্দ তাই ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল, এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায়। সেখানে আরো বলা হচ্ছে, মোগল আমল থেকেই নববর্ষে বৈশাখী মেলা ও হালখাতা অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল। এমন উদযাপন গ্রামাঞ্চলে এখনো বহাল।
শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে নববর্ষ উদযাপন নতুন মাত্রা পায় ষাটের দশকে। যখন রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয় যা এখন বৈশাখ বরণে জাতীয় পর্যায়ের প্রধানতম আয়োজন হিসেবে গণ্য। আর নববর্ষ আরো বর্নাঢ্য হয়েছে চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে, যার সূচনা তিন দশক আগে।
মোগল ঢাকার চিত্রকর্ম দেখে আঁচ করা যায় সেই সময়ে নায়েবে নাজিমদের ঈদ মিছিলের ধরন, আর বর্তমানে নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার যে আয়োজন- দুয়ের মাঝে অনেকটা মিল রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের উৎসব-পার্বণ গবেষক ইমরান উজ-জামান।
তিনি আরো বলেন, মোগল শাসনের অবসান হলে তাদের ঈদ মিছিলও হারিয়ে যায়। গত কয়েক বছরে এই মিছিল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা থাকলেও আয়োজকদের পরিকল্পনার ঘাটতি থাকায় তা সাড়া জাগাতে পারছে না বলে তিনি জানান।
এদিকে বাংলা নববর্ষের কাছাকাছি সময়েই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অন্তত তিনটি নতুন বছর শুরু হয়। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বিজু- এসব বর্ষবরণে পাহাড়ে বড় আকারের অনুষ্ঠান থাকে। তাদের নববর্ষ নিয়ে আয়োজন এখন ঢাকা শহরেও দেখা যায়। তবে এসব নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারছেন না জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। তিনি বলছেন, সব আয়োজনেই এখন বাণিজ্যিক ব্যাপার থাকে। এর ফলে পাহাড়ের আদিবাসীদের প্রকৃত রীতি ও সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। নৃগোষ্ঠীদের ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগ প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
দেশের ফ্যাশনের অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে ঈদুল ফিতর। কারণ এমন দিনে প্রায় সবার পরনে চাই নতুন পোশাক। তাই রোজার শুরু থেকেই প্রস্তুত হয়ে যায় সব বিক্রয়কেন্দ্র। দোকানগুলোয় এবার পোশাক বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০ হাজার কোটি টাকার মতো, জানিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। তাদের তথ্যমতে, ঈদ বাজার ঘিরে এই মৌসুমে আড়াই লাখ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলা নববর্ষ ঘিরেও পোশাকের আলাদা একটা বাজার আছে। বিশেষ করে দেশি বস্ত্র ও নিজস্ব নকশা নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের ব্যবসার প্রধান মৌসুম আসলে নববর্ষের উৎসব। গত কয়েক বছর নববর্ষ আসছে রোজার মধ্যে বা ঈদের কাছাকাছি সময়ে। এতে করে পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক পোশাক বিক্রি সেভাবে হচ্ছে না। ক্রেতারা ঈদের পোশাক সংগ্রহে বেশি মনযোগ দিচ্ছে। এবার ঈদ ও নববর্ষ প্রায় একই সময়ে। তাই পোশাকের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে একই পোশাকে দুটি উৎসবই প্রতিফলিত হয়- বলছিলেন ফ্যাশন হাউস নকশার কর্ণধার এটিএম জামাল।
তিনি আরো বলেন, ‘‘হিজরি সনের বাস্তবতার কারণে গত কয়েক বছর ধরে নববর্ষকেন্দ্রিক ব্যবসার সুযোগ থাকছে না। আরো এক-দুই বছর এটা থাকবে। তাই বৈশাখ নয়, আপাতত ঈদের ফ্যাশন নিয়েই ব্যবসার পরিকল্পনা করতে হবে। ডিজাইনের ক্ষেত্রে অবশ্য দেশি আবহ চর্চার কথা বললেন তিনি।
তবে উৎসবকেন্দ্রিক পোশাকে বিদেশি প্রভাব দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করেন লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞ, কবি শামীম আজাদ। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পোশাকে বিবর্তন এসেছে। সেগুলো আধুনিক হয়েছে, এবং বৈশ্বিক একটা ট্রেন্ড যুক্ত হয়েছে। এই ধারা নব্বই দশক অব্দি স্থিতিশীল ছিল। তারপর থেকে দেখা গেছে, বিদেশি প্রভাবে তৈরি সেসব আধুনিক পোশাক আমাদের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই থাকছে না।”
উৎসবের সঙ্গে খাদ্যসংস্কৃতিরও সম্পর্ক রয়েছে, এক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন দেখেন কিনা, জানতে চাইলে শিল্প-সংস্কৃতির অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব কবি শামীম আজাদ বলেন, ‘‘ঈদ ও নববর্ষ- দুটো আলাদা অনুষ্ঠান। ঈদে এক রকম খাবার। নববর্ষের খাবার আরেক রকম। আগে বৈশাখের খাবার আসতো গ্রামীণ সভ্যতা থেকে। এর মধ্যে আছে রসকদম, বাতাসা, মুড়ি, মুড়কি, খই। এখন গ্রামীণ মেলাগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সার্বিক অর্থনৈতিক কারণে বৈশাখী মেলার খাবারগুলোও সেভাবে আর পাওয়া যাচ্ছে না।”
ঈদের দিনের খাবার নিয়ে একটা সময় উৎসবমুখর যে ব্যাপার ছিল, তা আর সেভাবে থাকছে না বলে মনে করেন শামীম আজাদ। তিনি বলেন, রোজায় সংযমের পর ঈদের দিনে ভালো-মন্দ খাওয়ার একটা ব্যাপার আগে কাজ করতো। কিন্তু এখন সংযম কমে গেছে, রমজানে এখন ভোজের মতো উৎসব হয়, সেহেরি উৎসব হয়। রোজায় এখন মানুষ বেশি খাচ্ছে। তাই ঈদের দিনের খাবার নিয়ে সেই আগ্রহ আর আগের মতো দেখা যাচ্ছে না।
আপনার মতামত জানানঃ