নারায়ণগঞ্জে মৃত স্কুলছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় আটককৃতদের মারধর করে ধর্ষণ ও হত্যার মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা পুলিশদের পক্ষেই সাফাই গাইলেন হাইকোর্ট। উক্ত ঘটনাকে পুলিশ বাহিনীর গায়ে মাখানোর দরকার নেই বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। নারায়ণগঞ্জে মৃত স্কুলছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে শুনানিতে গতকাল বুধবার (১৩ জানুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্নভাবেই দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন। অন্যদিকে, আবেদনকারী পাঁচ আইনজীবীর পক্ষে শুনানি করেন মোহাম্মদ শিশির মনির। সাবেক তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী।
শুনানিতে মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, বিচারিক তদন্ত কমিটির রিপোর্টে পুলিশ বাহিনীর ওপর একটা দোষ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরঞ্জিত কিছু করেননি। তিনি তার আওতার মধ্যে থেকেই আসামি গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়েছেন। আসামিদের কোনো নির্যাতন করা হয়নি। কারণ, আসামিরা জুডিশিয়াল কমিটির বাইরে আর কারও কাছে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেননি।
তখন আদালত বলেন, জবানবন্দিতে আসামিরা যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা সত্য নয়। ভিকটিমকে মেরে নদীতে ফেলার যে জবানবন্দি তাতে আসামিদের স্বার্থ কী? এ বিষয়ে আমাদের একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
হাইকোর্ট বলেন, আমরা বিচারপতি, আমরা সব কথা কোর্টে বলতে পারি না। এখানে শুনানির সময় সাংবাদিকরাও থাকেন। ফাঁসি হবে জেনেও আসামিরা কি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছেন? জবানবন্দিতে আসামিরা মেয়েটিকে হত্যা করার কথা তাহলে কি শখ করে বলেছেন? এটা দুর্ভাগ্যজনক। অভাগা তো হলো এ দেশের জনগণ।
এ পর্যায়ে মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ভিকটিম বিচারিক কমিটির কাছে বলেছেন আসামি আবদুল্লাহ তাকে ধর্ষণ করেছেন।
আদালত বলেন, ২২ ধারায় জবানবন্দিতে মেয়েটি আদালতে কী বলেছেন? দুটো জবানবন্দির মধ্যে কোনটিকে আমরা ঠিক মনে করব?
শুনানিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার সরোয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, আসামিরা রিমান্ডের পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি দেওয়ার সময় তারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্যাতনের কথা বলেননি।
আদালত বলেন, আপনাদের দুজনের শুনানি গ্রহণ করলে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য বলে ধরে নিতে হয়।
মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিমকে উদ্ধার করেছেন, সে জন্য জুডিশিয়াল রিপোর্টে তার প্রশংসাও করা হয়েছে। এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক হবে না। তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক।
এর আগে নারায়ণগঞ্জে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় আসামিদের স্বীকারোক্তি আদায় সংক্রান্ত সদর থানার কার্যক্রমের বিষয়ে বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদন গত ৪ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সিলগালা করে দাখিল করা হয়।
আইনজীবীরা জানান, নারায়ণগঞ্জের দিসামনি হত্যা (পরবর্তীতে জীবিত) মামলার বিচারবিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা হওয়ার পরদিন ৫ জানুয়ারি মামলাটি ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করেছিলেন আদালত। আজ নির্ধারিত দিনে সেটির ওপর শুনানি শেষে আগামী ২০ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেন।
এর আগে নারায়ণগঞ্জে ‘ধর্ষণ ও হত্যার’ শিকার পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনার সার্বিক বিষয়ে বিচারিক অনুসন্ধান করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে ওই ঘটনার এফআইআর, জবানবন্দি, ভুক্তভোগী, আসামি সবার বক্তব্য দিয়ে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়। এর আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় করা মামলা এবং মামলা পরবর্তী প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা, বৈধতা এবং যৌক্তিকতা, মামলার নথি তলব চেয়ে গত বছরের ২৫ আগস্ট পাঁচ আইনজীবী হাইকোর্টে আবেদন করেন। ২৭ আগস্ট শুনানি শেষে ছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় সাবেক তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেন হাইকোর্ট। মামলার নথিসহ বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তাকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। সে অনুসারে তারা হাজির হয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর ব্যাখ্যা দেন। এরপর আদালত ২৪ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য দিন রাখেন। ওই দিন আদালত তদন্তের আদেশ দেন।
গত ৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জে ৫ম শ্রেণির ছাত্রী দিসা নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় দিসার বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা করেন। মামলার পর পুলিশ আব্দুল্লাহ, রকিব ও খলিল নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। স্বীকারোক্তিতে জানান, তারা স্কুলছাত্রী দিসাকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেন। জবানবন্দি গ্রহণের পর আসামিদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু গত ২৩ আগস্ট দিসাকে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ঘটনায় পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে তদন্ত কর্মকর্তা আসামিদের মারধর, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ ও খুনের স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেন। তবে প্রকৃতপক্ষে এ তিনজন ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ধর্ষণ ও হত্যা না করেও অভিযুক্তদের মারধর করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা পুলিশের পক্ষে সাফাই গেয়ে আদালত পুলিশের অপকর্ম ধামাচাপা দিয়ে তাদের ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করেছেন। ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটেইনি যেখানে, সেখানে অভিযুক্তরা ধর্ষণ হত্যা করেছে মর্মে স্বীকারোক্তি দেয় নির্যাতনের কোন পর্যায়ে গেলে, আদালত বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বলে মনে করেন। কেবল নারায়ণগঞ্জেই যে এমন ঘটনা ঘটেছে তা নয়। দেশব্যাপী পুলিশের নির্যাতনের বিষয়ে সকলেই ওয়াকিবহাল আছে। নির্যাতন কতটা ভয়াবহ হলে একজন মানুষ ধর্ষণ ও হত্যার কথা স্বীকার করে যা আসলে ঘটে নাই, এবিষয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আদালত বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পুলিশকে দায়মূক্ত করতে চাইলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আদালত এতে আরো ঘটনার জন্য পুলিশকে পরোক্ষভাবে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিয়ে দিলো। উক্ত ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ তৈরী করা দাবি জানান তারা যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৯
আপনার মতামত জানানঃ