করোনা মহামারির রেশ কমতে না কমতেই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তোলে। জ্বালানি, সার ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। বাড়তি আমদানি ব্যয় মেটাতে কমতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘কৃচ্ছ্রসাধন’ নীতি গ্রহণ করে সরকার।
নির্বাচনের পর সেই নীতি থেকে বেরোনোর প্রচেষ্টা থাকলেও সরকারের প্রকল্প পড়েছে টাকার সংকটে। বরাদ্দ নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এ পরিস্থিতিতে প্রকল্প গ্রহণকারী মন্ত্রণালয়গুলো টাকা চেয়ে একের পর এক চিঠি পাঠাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিগত তিন বছরে সরকারের কৃচ্ছ্রনীতির কারণে অনেক প্রকল্প আটকে গেছে।
এখন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসায় মানুষের আকাক্সক্ষা বেড়েছে। জনপ্রতিনিধিরাও গৃহীত প্রকল্পগুলো শেষ করার বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোতে আধা সরকারি (ডিও লেটার) চিঠি পাঠাচ্ছেন। আবার নতুন মন্ত্রীরা দায়িত্ব গ্রহণের পর নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে গতি আনার উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। গৃহীত প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন তারাও।
ফলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর অর্থ ছাড়ের অনুরোধ জানিয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন চিঠি আসছে। বাস্তবতা হচ্ছে, যে হারে চিঠি আসছে, সে হারে অর্থ জমা হচ্ছে না সরকারের তহবিলে। রাজস্ব ঘাটতির কারণে নগদ টাকার সংকট রয়েছে।
সূত্র জানায়, গত দুটি অর্থবছরে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে সব ধরনের যানবাহন, জলযান, আকাশযান কেনা স্থগিত করা হয়। পরিপত্র জারি করে ১ হাজার ৪৮৭টি প্রকল্পকে এ, বি ও সি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে, বি ক্যাটাগরির প্রকল্পে সরকারি অংশের ২৫ শতাংশ এবং সি ক্যাটাগরির প্রকল্পে সম্পূর্ণ বরাদ্দ বন্ধ রাখা হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরেও প্রকল্পগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে উচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্পে বরাদ্দ ঠিক রেখে মধ্যম অগ্রাধিকার প্রকল্পে সরকারি অংশের ৫০ ভাগ অর্থ কমানো ও নিম্ন অগ্রাধিকার প্রকল্পে বরাদ্দ স্থগিত রাখা হয়েছিল। নতুন সরকার ক্ষমতায় এলেও কৃচ্ছ্রনীতির পরিবর্তন হয়নি। কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে আগে যেসব প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল তার মধ্যে অনেকগুলোর বরাদ্দ কমে গেছে।
ঝুলে গেছে নির্বাচন কমিশনের প্রকল্প
২০২০ সালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহেন্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) প্রকল্প’ একনেকে অনুমোদিত হয়। ১ হাজার ৮০৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের নভেম্বরে।
বরাদ্দ না থাকায় এটির অগ্রগতি নেই বললেই চলে। গত ৩০ জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসেবে দেখা যায় প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১৭ শতাংশের কাছাকাছি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, সরকারের কৃচ্ছ্র নীতির কারণে প্রকল্পটির অর্থ পুরো ছাড় করা হয়নি। করোনা মহামারির কারণে ঠিকভাবে জনবলও নিয়োগ করা যায়নি। ফলে দুদিক থেকেই প্রকল্পের গতি কমেছে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি শেষ করতে অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় জানিয়েছে, ‘প্রকল্পটি বি ক্যাটাগরি হওয়ায় ২৫ শতাংশ অর্থ ছাড় করেনি অর্থ বিভাগ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত (কৃচ্ছ্রসাধন) পরিপত্রের কারণে কয়েকটি খাতে ব্যয়ও কম হয়েছে। এ অবস্থায় আগামী ২৯ মাসে প্রকল্পের ৮৩ শতাংশ কাজ শেষ করতে হবে। ’ প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করার লক্ষ্যে ২০২১-২২ অর্থবছর ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে অব্যয়িত ৪১৭ কোটি ৭২ লাখ টাকাসহ চলতি অর্থবছরে ৭৫১ কোটি ৪৭ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে চিঠিতে।
পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই আইএমইডির প্রকল্পে
সরকারের অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি দেখভাল করে যে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)-তারই প্রকল্প পড়েছে অর্থ সংকটে। গত সপ্তাহে অর্থ বিভাগে চিঠি দিয়ে আইএমইডি জানিয়েছে, অপর্যাপ্ত বাজেটের কারণে দুটি প্রকল্পের উন্নয়ন বাজেটের আইবাসে ঢুকতে পারেননি তারা। চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আইএমইডির উন্নয়ন ও পরিচালন মিলিয়ে ৭১ কোটি ১৯ লাখ টাকার বাজেট সিলিং দেওয়া হয়েছে।
অথচ প্রকল্প দুটির উন্নয়ন বাজেট বাবদ ১১৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। সরকারি কেনাকাটায় সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি এটিকে ডিজিটাইজেশন করার জন্য ‘ডিজিটাইজিং ইমপ্লিমেনটেশন মনিটরিং অ্যান্ড পাবলিক প্রকিউরম্যান্ট প্রজেক্ট (ডিআইএমএপিপিপি) এবং ফলাফলভিত্তিক পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতির কার্যকর ব্যবহারে আইএমইডির সক্ষমতা বাড়াতে (প্রথম সংশোধিত) গৃহীত প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন হলে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও আইএমইডি জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, আগের কিছু প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ রকমই আরেকটি প্রকল্প আছে আকাশযান কেনার। কৃচ্ছ্রনীতির কারণে নতুন কেনাকাটা বন্ধ রাখলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে আকাশযান কেনার চতুর্থ কিস্তি পরিশোধ বকেয়া রয়েছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যেই কিস্তির টাকা পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এটি যেহেতু বিদেশি (জার্মানি) দায়, সময়মতো পরিশোধ না করতে পারলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবর্মূতি সংকট ঘটবে। এ কারণে জরুরি বরাদ্দ চেয়ে অর্থ বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছে। অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চতুর্থ কিস্তির অর্থ বাবদ প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ ইউরোর সমপরিমাণ বরাদ্দ প্রয়োজন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাসানুল মতিন (বাজেট ২) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে প্রকল্পের টাকা বন্ধ আছে, এমন নয়; আমরা টাকা ছাড় করছি।
সুনির্দ্দিষ্টভাবে যদি জানা যায়, কোনো প্রকল্প টাকার কারণে আটকে আছে, তবে সেটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আর সরকারের কৃচ্ছ্রনীতি অনুযায়ী প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে যে পরিপত্র জারি হয়েছে, সেটির এখনো বদল হয়নি। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনাও আসেনি।
আপনার মতামত জানানঃ