আমেরিকার এক কুখ্যাত পানশালা। আলাস্কা প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অপরাধীদের ঠেক বলা যেতে পারে একে। ভিতরে ভিতরে চলে শরীরী ব্যবসা। কিটি ওরেন ছিলেন সেরকমই এক মহিলা। কিন্তু সেবার বিশ্বাসঘাতকতা করল পানশালারই এক কর্মচারী। প্রাপ্য অর্থ না মিটিয়ে বরং আক্রমণ করে বসল কিটিকে। খবর পৌঁছোল কিটির ‘প্রেমিক’ রবার্ট স্ট্রাউডের (Robert Stroud) কানে।
রগচটা এই লোকটাকে নিয়ে ভয়ে থাকে পরিচিত সবাই। কখন যে কার সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়বে, কেউ জানে না। এবার আর হাতাহাতি নয়, সোজা গুলি করে বসল পানশালার ওই কর্মচারীকে। বিচারে বারো বছরের সাজা হল তাঁর। রায় ঘোষণার সময় মুখে-চোখে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ছিল না। নৃশংস চোখ দুটি দেখে আঁতকে উঠেছিল অনেকেই। এমন অপরাধীর কি আদৌ সংশোধন সম্ভব? জেলে গিয়েও নিশ্চয়ই জড়িয়ে পড়বে ঘৃণ্য কাজে। শুরুটা সেভাবেই হয়েছিল। তারপর বদলে গেল রবার্টের জীবন। নেপথ্যে তিনটি চড়ুই পাখি।
অবশ্য এর আগেও একাধিক বাঁকবদল এসেছে রবার্টের জীবনে। ১৮৯০ সালে জন্ম তাঁর। পিতা ছিল চূড়ান্ত মদ্যপ। লাগাতার অত্যাচার আর দারিদ্র্য থেকে বাঁচতে মাত্র ১৩ বছর বয়সে পালিয়ে আশ্রয় নেন আলাস্কাতে। কাজ জোটে এক পতিতাপল্লীতে। সেখানেই পরিচয় কিটির সঙ্গে।
সকলেই জানত, এই যুবক যেমন পাগলের মতো ভালোবাসতে পারে, তেমনই চণ্ডালের মতো রাগ তাঁর। লোকে ভয় পেত তাঁকে, বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য শ্রদ্ধাও করত অনেকে। তারপরই ঘটল পানশালার ঘটনা। রবার্টের বয়স তখন মাত্র ১৯। ম্যাকনিলের জেলখানাতে সে খুলে বসল মাদক চোরাচালানের ব্যবসা।
সব কয়েদিই জানত সে খবর, কিন্তু কার ঘাড়ে কটা মাথা যে রবার্টের বিরুদ্ধে কথা বলবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত খবর পৌঁছোল কর্তৃপক্ষের কাছে। জনৈক কর্মচারী করেছে এই দুঃসাহসের কাজ। রবার্টের হাতের ছুরি সোজা গিয়ে বিঁধল তার পিঠে। তাঁকে আটকাতে গিয়ে গুরুতর জখম হয় আরো কয়েকজন।
তড়িঘড়ি তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল লেভেনওয়ার্থ জেলখানায়। কয়েদিদের নিয়মকানুন বিষয়ে যথেষ্ট কড়াকড়ি ছিল এখানে। কিন্তু আবারও ঝামেলায় জড়ালেন রবার্ট। ১৯১৬-তে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি না দেওয়ায় হত্যা করেন এক রক্ষীকে। আবার বিচার হল তাঁর, এবারের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যদিও, স্বয়ং রাষ্ট্রপতি হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডই বরাদ্দ হয় তাঁর জন্য।
স্বাভাবিকভাবেই অখুশি লেভেনওয়ার্থ জেলখানার কর্তৃপক্ষ রবার্টকে পাঠিয়ে দিল নির্জন কারাগারে। কারোর সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলার অনুমতি পর্যন্ত রইল না। আর সেই সময়ে তাঁর জীবনে এসে জুটল তিনটি চড়ুই পাখি। অন্ধ কারাগারের যে ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে সকালের রোদ আসে, সেখানেই বাসা তাদের। সকাল হলেই কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় রবার্টের।
তাঁর রাগ-বিরক্তির পরোয়াই করে না পাখিগুলি। সারাদিন তারা ঘুরে বেড়ায় বাইরে বাইরে। সন্ধ্যার সময় ফিরে এসে রবার্টকে যেন বাইরের মুক্ত পৃথিবীর গল্প বলে। কিন্তু একদিন যে কী হল তাদের! ভোর গড়িয়ে বেলা হতে চলল, তবু তাদের ডানার ঝটপটানি শোনা যাচ্ছে না কেন? রবার্ট দেখলেন, গুরুতর আহত তারা।
একাধিক খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত রবার্ট এই প্রথমবার বোধহয় হেরে গেল নিজের কাছে। সেবা-শুশ্রূষায় সুস্থ করে তুলল পাখিগুলিকে। আর সেই সময়ে কেমন যেন একটা পরিবর্তন অনুভব করলেন নিজের মধ্যে। যার সঙ্গে বহুদিন দেখা হয়নি রবার্টের। তার নাম, ভালোবাসা। জেলে বন্দিদের পাখি কেনাবেচার নিয়ম ছিল। যেটুকু সম্বল ছিল, তাই দিয়েই ঘরে নিয়ে এলেন কয়েকটি ক্যানারি পাখি। সারাদিন কেটে যেত এদের সঙ্গেই।
এখন আগের থেকে অনেক শান্ত তিনি। কোথায় যেন উবে গেছে সেই রগচটে মেজাজটা। ক্রমে নেশা জাগে পাখি সংক্রান্ত বই পড়ার। কর্তৃপক্ষও সাহায্য করত সুবিধামতো বই, খাতাপত্র এনে দিয়ে। ১৯৩৩ সাল নাগাদ প্রকাশিত হয় রবার্টের প্রথম বই, ‘ডিজিজ অফ ক্যানারিজ’। l
জেল থেকে চোরাই পথে প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পাণ্ডুলিপি। আর এ কাজে তো তাঁর ইতিমধ্যেই খ্যাতি ছিল। যাই হোক, বাইরের দুনিয়ার মানুষের কাছে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠল এক জেলবন্দির গবেষণা।
১৯৪২-এ রবার্টকে স্থানান্তরিত করা হয় বিখ্যাত আলকাত্রাজ জেলে। সঙ্গে নিয়ে গেলেন ৩০০ ক্যানারি পাখি। পরের বছর প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ, ‘ডাইজেস্ট অন দ্য ডিসিজ অফ বার্ডস’। পক্ষীবিদদের মধ্যেও চাঞ্চল্য পড়ে যায় বইটি নিয়ে। রবার্টের নাম হয়ে যায় ‘বার্ডম্যান অফ আলকাত্রাজ’ (Birdman of Alcatraz)।
জীবনের পরবর্তী বছরগুলি এখানে কাটানোর পর ১৯৬৩ সালে মৃত্যু ঘটে তাঁর। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর জীবনীগ্রন্থ। ১৯৬২ সালে শুরু হয় রবার্টের জীবন নিয়ে সিনেমা তৈরির কাজ। যার জন্য অস্কার পান অভিনেতা বার্ট ল্যাঙ্কেস্টার। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, নিজের জীবন নিয়ে তৈরি সিনেমা দেখে যাওয়ার সুযোগ পাননি রবার্ট স্ট্রাউড।
আপনার মতামত জানানঃ