ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়া, নন বাইনারি এসব শব্দ দিয়ে কাদের বোঝায়? এলজিবিটিকিউআইএ+ দিয়েই বা কী বোঝানো হয়? সে বিষয়ে জানার আগে লিঙ্গ এবং জেন্ডারের পার্থক্য এবং এর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, লিঙ্গ বা সেক্স বলতে একজন মানুষের জৈবিক এবং শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যকে বোঝায়। সাধারণত ক্রোমোজোম, ব্যক্তির প্রজনন অঙ্গ, হরমোনের ধরন প্রভৃতির ভিত্তিতে সেক্স নির্ধারিত হয়।
স্ত্রী লিঙ্গের শরীরে জরায়ু, এক্সএক্স ক্রোমোজোম এবং উচ্চ মাত্রায় এস্ট্রোজেন হরমোন থাকে। পুরুষ লিঙ্গের শরীরে জননাঙ্গ, এক্সওয়াই ক্রোমোজোম, উচ্চ মাত্রায় টেস্টোস্টেরন হরমোন থাকে। এসবের প্রভাবে নারী পুরুষের বাহ্যিক গড়নেও ভিন্নতা দেখা দেয়।
অন্যদিকে, জেন্ডার বলতে ব্যক্তি নিজেকে মানসিকভাবে যে লিঙ্গের কাতারে অনুভব করে তা বোঝায়। জেন্ডার কোনো ব্যক্তির লিঙ্গ বৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্ধারিত হয় না। সে নিজেকে কী ভাবে সেটার ওপর নির্ভর করে।
জেন্ডার পরিচয় এবং যৌন অভিমুখিতা
জেন্ডার আইডেন্টিটি (জেন্ডার পরিচয়) এবং সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন (যৌন অভিমুখিতা) নিয়ে প্রায়শই বিভ্রান্তি দেখা দেয়। হিউম্যান রাইটস ক্যাম্পেইনের তথ্য মতে, জেন্ডার আইডেন্টিটি হলো ব্যক্তি নিজেকে যে লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন এবং নিজেকে কী হিসেবে পরিচয় দেন। এটি তার লিঙ্গের সাথে মিলতে পারে আবার নাও মিলতে পারে।
সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন হলো ব্যক্তি কার প্রতি সহজাত, রোমান্টিক, যৌন আকর্ষণ বোধ করছেন। এটি একজন মানুষের খুব ব্যক্তিগত বিষয়। জেন্ডার আইডেন্টিটি এবং সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নানা ধরনের হয়ে থাকে।
সাধারণত পুরুষরা নারীর প্রতি এবং নারীরা পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। এই যৌন অভিমুখিতাকে স্ট্রেইট বা বাংলায় বিপরীতকামিতা বলা হয়। অর্থাৎ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ।
আবার সমকামী অর্থাৎ লেসবিয়ান (নারীর প্রতি নারীর আকর্ষণ), গে (পুরুষের প্রতি পুরুষের আকর্ষণ), বাইসেক্সুয়াল বা উভকামী (নারী পুরুষ উভয়ের প্রতি যৌন আকর্ষণ) ইত্যাদিও বিভিন্ন ধরনের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন।
সিসজেন্ডার
যখন কোনো ব্যক্তি যে লিঙ্গ নিয়ে জন্মেছে সে অনুযায়ী নিজের জেন্ডার ধারণ করেন, তখন তাকে সিসজেন্ডার বলা হয়। অর্থাৎ, পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করা ব্যক্তি যখন নিজেকে পুরুষ পরিচয়ে কিংবা নারীর যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্ম নেয়া কেউ যদি নিজের পরিচয় নারী দেয় তাহলে তারা সিসজেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত। একে বাইনারি জেন্ডার পরিচয়ও বলা হয়।
জেন্ডার বাইনারি ধারণায় বিশ্বাস করা হয় যে বিশ্বে শুধুমাত্র দুটি জেন্ডার রয়েছে। একটি নারী এবং আরেকটি পুরুষ। তবে বাস্তবে জেন্ডারের ধারণা আরও অনেক বিস্তৃত। একে স্পেকট্রাম বলা হয়। স্পেকট্রামের বাংলা অর্থ বর্ণালি বা অনেক রঙের পাশাপাশি অবস্থান।
এর মাধ্যমে বিভিন্ন জেন্ডারের মানুষদের সহঅবস্থানকে প্রতীকী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গ
সিসজেন্ডারের ঠিক উল্টোটাই ট্রান্সজেন্ডার। অর্থাৎ কেউ যদি জন্মসূত্রে যে লিঙ্গ পেয়েছে তার পরিচয় না দিয়ে ভিন্ন পরিচয় দেয় তাহলে তাকে ট্রান্সজেন্ডার বলা হয়। যেমন- ট্রান্সজেন্ডার নারী এমন একজন যিনি বর্তমানে নিজেকে নারী হিসাবে পরিচয় দিলেও তিনি জন্মেছেন পুরুষ লিঙ্গ নিয়ে।
তার মুখে দাড়ি, কণ্ঠ মোটা এং শারীরিক গড়ন পুরুষের মতো হলেও তিনি নিজেকে নারী পরিচয় দিয়ে থাকেন। কারণ পুরুষের লিঙ্গ ও বৈশিষ্ট্য থাকলেও তিনি নিজেকে পুরুষ মনে করেন না।
তারা নারীদের মতো বেশ ধরেন, আচার-আচরণ মেয়েলি হয়। এক কথায় পুরুষের কোনো বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে পাওয়া যায় না। একইভাবে ট্রান্সজেন্ডার পুরুষ এমন একজন যিনি বর্তমানে পুরুষ পরিচয় দিলেও তিনি জন্মেছেন নারীর লিঙ্গ নিয়ে।
তাদের শারীরিক গড়ন নারীদের মতো হলেও আচরণে কোনো নারীসুলভ বিষয় থাকে না। ট্রান্সজেন্ডার নারী এবং ট্রান্সজেন্ডার পুরুষদের যৌন অভিমুখিতা, বিপরীতকামী, সমকামী, উভকামী হতে পারে।
ইন্টারসেক্স, হিজড়া, তৃতীয় লিঙ্গ
অন্যদিকে ইন্টারসেক্স বা উভলিঙ্গের মানুষদের জননাঙ্গ পুরুষ বা স্ত্রী লিঙ্গের চাইতে ভিন্ন হয়। তাদের ক্রোমোজোম পুরুষ বা নারীর মতো থাকতে পারে তবে তাদের হরমোন ক্ষরণের মাত্রায় ভিন্নতা থাকতে দেখা গিয়েছে।
ইন্টারসেক্স মানুষ অনেক সময় ইন্টারসেক্স, ট্রান্সজেন্ডার, নন বাইনারি কিংবা বাইনারি অর্থাৎ নারী বা পুরুষ হিসেবে নিজের জেন্ডার পরিচয় দিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ইন্টারসেক্স বা ট্রান্সজেন্ডারদের হিজড়া বলা হয়। হিজড়া হলো যারা পুরুষ হয়ে জন্ম নিলেও কিংবা পুরুষের মতো গড়ন হলেও তাদের আচার আচরণ নারীদের মতো।
দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের মানুষ আলাদা সম্প্রদায় করে থাকে। যারা সম্পূর্ণ আলাদাভাবে ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠে। বেশিরভাগ হিজড়ারা নিজেদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ বলেও মনে করে।
নন বাইনারি বা জেন্ডার ফ্লুইড
নন বাইনারির মধ্যে বেশ কয়েকটি জেন্ডার পরিচয় রয়েছে। যেমন: জেন্ডার নিউট্রাল, জেন্ডার ফ্লুইড, জেন্ডার কুয়ের, জেন্ডার ডাইভার্স, এজেন্ডার, বাইজেন্ডার, প্যানজেন্ডার, জেন্ডার ফ্লাক্স, ওমনি জেন্ডার, ডেমি জেন্ডার ইত্যাদি। তবে একটি দল হিসেবে তারা নিজেদের সাধারণত নন বাইনারি বলে উল্লেখ করে থাকে।
যদি কোনো ব্যক্তি মনে করেন যে তিনি পুরুষ কিংবা নারী কোনোটাই নয়, তখন তিনি নন-বাইনারি বা জেন্ডার নিউট্রাল হিসেবে পরিচিত হবেন। তারা নিজেদেরকে কোনো জেন্ডার বাইনারির মধ্যে ফেলেন না অর্থাৎ তিনি নারী বা পুরুষ কোনো লিঙ্গেই নিজেকে পুরোপুরি বা আংশিক অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন না।
তাদের মতে, লিঙ্গ পরিচয়ের কোনো ধারণাই তাদের জন্য প্রয়োজ্য নয়। জেন্ডার ফ্লুইড হলো যখন কোনো ব্যক্তি নিজেকে কোনো সুনির্দিষ্ট একটি জেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন না কিংবা কোনো একটি লিঙ্গ পরিচয়ে নির্দিষ্ট থাকেন না।
জেন্ডার কুয়েরভুক্ত মানুষও জেন্ডারের কোনো ক্যাটাগরিকেই স্বীকার করেন না এবং তারা লিঙ্গ পরিচয়ের ক্ষেত্রে ফ্লুইডিটি বা পরিবর্তনশীলতাকে ধারণ করে।
জেন্ডার ফ্লুইড বা জেন্ডার কুয়েরভুক্তরা কখনও কখনও নিজেকে নারী, কখনও বা নিজেকে পুরুষ মনে করেন। কখনও নারী ও পুরুষ দুটোই মনে করেন। আবার কখনও কোনোটিই মনে করেন না।
অর্থাৎ অনেক সময় তারা একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না, লিঙ্গ পরিচয় সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। আবার একইসাথে নিজেকে সব লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত বলেও অনুভব করতে পারেন।
এর অর্থ হলো তারা পুরুষ এবং নারী উভয় লিঙ্গের অংশ কিংবা ভিন্ন লিঙ্গ বা কোনো লিঙ্গের নয় এমন অনুভব করে থাকে।
জেন্ডার নন কনফর্মিং
কোন ব্যক্তি যদি জেন্ডারের তথাকথিত গৎবাঁধা ধারণায় বিশ্বাসী না হন বা নির্দিষ্ট জেন্ডারের ভূমিকা মেনে না চলেন তাহলে তিনি জেন্ডার নন কনফর্মিং হতে পারেন। এটি সেইসব মানুষদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় যারা তাদের জৈবিক লিঙ্গ অনুযায়ী আচরণ করেন না এবং তারা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ক্যাটাগরিতেও পড়েন না।
জেন্ডার নন কনফর্মিং মানুষেরা ট্রান্সজেন্ডার হতে পারে আবার নাও হতে পারে। এলজিবিটিকিউআইএ রিসোর্স সেন্টারের মতে, এ ধরণের মানুষ লিঙ্গ পরিচয়ের পরিবর্তে লিঙ্গ অভিব্যক্তি বোঝাতে জেন্ডার নন কনফর্মিং শব্দটি ব্যবহার করে।
তারা সাধারণত এমন সব ‘পুরুষালি’ বা ‘মেয়েলি’ বেশভূষা এবং আচরণ বেছে নেয় যা সমাজ স্বীকৃত নয়। অর্থাৎ জন্মের সময় নির্ধারিত নারী বা পুরুষ লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে তাদের যেমন আচরণ বা বেশভূষা হওয়া উচিত সমাজ বা অন্য মানুষের সে সংক্রান্ত ধারণা তারা পরোয়া করে না।
ট্রানজিশন/ জেন্ডার এক্সপ্রেশন
যদি কোনো ব্যক্তি তার জেন্ডার আইডেন্টিটি বা তিনি নিজেকে নারী বা পুরুষের মধ্যে যেটি মনে করেন যে অনুযায়ী নিজেকে পরিবর্তন করেন তাকে জেন্ডার ট্রানজিশন বলা হয়। যেমন: অনেকেই নিজের নাম, ইংরেজিতে নিজের সর্বনাম (হি/শি) ও সম্বোধন (মিস্টার/মিস, স্যার/ম্যাডাম) বদলে ফেলেন। সেইসাথে পোশাক, চুলের ছাঁট ও সাজসজ্জায় পরিবর্তন আনেন।
সেইসাথে লিঙ্গ-নির্ধারণকারী হরমোন গ্রহণ, প্রজনন অঙ্গ পরিবর্তনে অস্ত্রোপচারসহ শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনে বিভিন্ন চিকিৎসা নেয়া এই ট্রানজিশনের অংশ।
এমন চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে ট্রান্স সেক্সুয়ালও বলা হয়। তবে সব ট্রান্সজেন্ডার ট্রানজিশন করেন না। জেন্ডার এক্সপ্রেশন বলতে বোঝায় মানুষ তার জেন্ডার আইডেন্টিটিকে কীভাবে বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করতে চায়, সেই প্রক্রিয়া।
জেন্ডার ডিসফোরিয়া/জেন্ডার ইউফোরিয়া/ কোয়েশ্চেনিং
জেন্ডার ডিসফোরিয়া এবং জেন্ডার ইউফোরিয়া জেন্ডার সংক্রান্ত বহুল ব্যবহৃত শব্দের দুটি। কারও যদি লিঙ্গ পরিচয় এবং জেন্ডার পরিচয় ভিন্ন হয়। অর্থাৎ পুরুষ লিঙ্গ নিয়ে জন্মালেও নিজেকে নারী বলে বা নারী লিঙ্গ নিয়ে জন্মে নিজেকে পুরুষ বলে অনুভূত হয় তাহলে তারা ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যান একে মেডিকেলের ভাষায় জেন্ডার ডিসফোরিয়া বলে।
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন কিছু ট্রান্সজেন্ডার মানুষের ওপর গবেষণা করে দেখেছে যে এ ধরনের মানুষ ভীষণ মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। জেন্ডার ডিসফোরিয়া একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্য, সুস্থতা এবং দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।
লিঙ্গ ডিসফোরিয়া শিশুকালে দেখা দিতে পারে। তবে বেশিরভাগ বয়ঃসন্ধির আগ পর্যন্ত কেউ এটি টের পান না। কোনো ট্রান্সজেন্ডার বা নন বাইনারি মানুষ যদি তার জেন্ডার পরিচয় নিয়ে আনন্দ এবং স্বস্তি অনুভব করে তখন তাকে বলে জেন্ডার ইউফোরিয়া।
তারা যদি নিজেদের জেন্ডার পরিচয়ের সাথে তাদের শরীর এবং জেন্ডার এক্সপ্রেশনের সমন্বয় খুঁজে পান তাহলে জেন্ডার ইউফোরিয়া অনুভূত হতে পারে।
যখন সমাজে তাদেরকে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয়, সমান সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, যখন মানুষ তাদের ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক দৃষ্টি পোষণ করে তখন তারা এই উচ্ছ্বাসে ভেসে যায়। যেমন ট্রান্সজেন্ডার নারীকে কেউ যদি নারী বলে সম্বোধন করে তাহলে তারা সম্মানিত বোধ করে।
এদিকে যারা এখনও নিজেদের জেন্ডার আইডেন্টিটি নির্ধারণ করতে পারেননি কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তাকে কোয়েশ্চেনিং বলা হয়। সূত্র: বিবিসি।
আপনার মতামত জানানঃ