ধান্নিপুর গ্রামটি উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা শহর থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ছোট ছোট বাড়ি, কিছু দোকান, কয়েকটা মসজিদ এবং একটা মাদ্রাসা- সর্বসাকুল্যে এগুলোই চোখে পড়ে স্বল্প বসতির এই গ্রামটিতে।
এই গ্রামে ঢুকতেই রাস্তার পাশে বেশ বড় একটি খালি জায়গা চোখে পড়ে। সেখানে কয়েক জন যুবক ক্রিকেট খেলছে এবং একজন ছাগল চরাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে হয়তো জায়গাটি সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু সামনে স্থাপিত একটি ফলক এর আসল চেহারা তুলে ধরছে।
সেখানের বোর্ডে একটি ভবনের ছবি রয়েছে, যাতে লেখা ‘ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন’। ২০১৯ সালে অযোধ্যা মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের বিতর্কিত জায়গাটি একটি ট্রাস্টকে দেওয়া যেতে পারে এবং সেখানে একটি রাম মন্দির তৈরি করা যেতে পারে।
একইভাবে, উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে বলা হয় যে, তাদেরকে পাঁচ একর জমি দেওয়া হবে, যেখানে তারা একটি মসজিদ তৈরি করতে পারবে। মূলত: এটাই সেই জমি। আর মসজিদটি নির্মাণের জন্য ওয়াকফ বোর্ডের তৈরি করা সংস্থাই হচ্ছে ‘ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন’।
‘রামাজন্মা ভূমি তীর্থক্ষেত্র ফাউন্ডেশন’ যখন বাবরি মসজিদের বিতর্কিত জায়গাটিতে রাম মন্দির নির্মাণে ব্যস্ত এবং মন্দিরের প্রথম ধাপের কাজ প্রায় শেষ করতে চলেছে, তখন মসজিদ নির্মাণের জন্য বরাদ্দকৃত জমিতে কাজ শুরুর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
যদিও ইতিমধ্যে ওই জমিতে বেশ আগে নির্মিত পুরানো একটি দরগা সংস্কার করা হয়েছে। এর দেয়ালের গায়ে সংযুক্ত একটি ছবিতে নির্মিতব্য মসজিদের অবকাঠামো দেখানো হয়েছে। সেখানে মসজিদটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে ‘মসজিদ মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ’।
বিবিসি যখন ধান্নিপুর গ্রামে গিয়েছিল, তখন সেখানকার বাসিন্দারা মসজিদের অবস্থান কিংবা শহরের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি, গণমাধ্যমকর্মী জানতে পেরে রাস্তা ঘুরাফেরা করতে থাকা কয়েকজনকে দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তে দেখা গেছে।
মসজিদের কাজ শুরু হয়নি কেন?
অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জমি নিয়ে বিরোধের মামলার বাদী ছিলেন ইকবাল আনসারি। মূলত: তার বাবা হাশিম আনসারিই একই মামলার বাদী ছিলেন। ২০১৬ সালে তার মৃত্যুর পর মি. ইকবাল মামলাটি চালিয়ে যান।
মি. ইকবাল বর্তমানে নির্মাণাধীন রাম মন্দিরের খুব কাছেই একটি ছোট বাড়িতে থাকেন। দু’জন সশস্ত্র পুলিশ সদস্য এখন তাকে সার্বক্ষণিকভাবে নিরাপত্তা দেন।
বাড়ির বসার ঘরে ঢুকতেই দেওয়ালে মি. ইকবালের বাবার ছবি এবং বাবরি মসজিদের একটি ছবি আমাদের স্বাগত জানায়। গণমাধ্যমকর্মীরা রীতিমত তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
সাক্ষাৎকার শেষ করে তিনি আমাদের সাথে কথা বলতে শুরু করেন। বরাদ্দকৃত জমিতে মসজিদ নির্মাণের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়ে তার হতাশার কথা শোনান।
“জমি ওয়াকফ বোর্ডকে বরাদ্দ করা হয়েছে। সেখানে মসজিদ নির্মাণের দায়িত্ব তাদের। এ জন্য তারা একটি ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছেন। কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ভারতের মুসলমানরাও এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে না,” বলেন মি. ইকবাল।
তিনি দাবি করে যে, তার বাবা মি. হাশিম যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন বাবরি মসজিদের দেখাশোনা করেছেন। কাজেই তিনি চাইলে কোনো কথা না বলে চুপচাপ মসজিদের জমিতে ফসল চাষ করতে পারতেন এবং আশপাশের হিন্দু-মুসলিমদের সাথে সেই ফসল ভাগ করে নিতে পারতেন।
তিনি বলেন, সেখানে মুসলমানরা নতুন মসজিদ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন, কারণ তাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক মসজিদ রয়েছে।
‘মসজিদের বিকল্প নেই’
মুসলমানদের আরেক একজন প্রতিনিধি হলেন অযোধ্যার বাসিন্দা খালিক আহমেদ খান। তিনি বাবরি মসজিদের মামলাটির দিকে বেশ কাছ থেকে লক্ষ্য রেখেছিলেন। মি. খালিদ বিবিসিকে বলেছেন যে, মুসলমানরা নতুন মসজিদ নির্মাণে খুব বেশি আগ্রহী নন।
ইসলামী শরিয়া আইন এবং ওয়াকফ বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী, “একটি মসজিদকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানো যাবে না এবং একটি মসজিদকে অন্য কোনো মসজিদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাবে না।”
“ইসলামী আইন অনুযায়ী, কোনো মসজিদের জায়গা পরিবর্তন করা, বন্ধক রাখা বা একটি মসজিদের পরিবর্তে অন্য মসজিদ নেওয়া জায়েজ নয়।
এটি অনুযায়ী, বাবরি মসজিদের জায়গায় অন্য কোনো মসজিদ নির্মাণ করা যাবে না। আর এ জন্যই, মুসলমানরা নতুন মসজিদ নির্মাণের ঘোষণায় আগ্রহী নন,” তিনি বলেছিলেন।
তবে তিনি এটাও বলেন যে, নতুন মসজিদ নির্মাণের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটার বিরুদ্ধেও কেউ দাঁড়ায়নি।
নির্মাণ কাজ শুরু হবে কবে?
এ বিষয়ে আমরা মসজিদটির ট্রাস্টের সেক্রেটারি আত্তার হুসাইনের সাথে কথা বলেছিলাম, যিনি উত্তর প্রদেশ রাজ্যের রাজধানী লখনৌতে বসবাস করেন।
তিনি আমাদের বলেন যে, মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত তহবিল না থাকা। তিনি এটাও বলছিলেন যে, ওয়াকফ বোর্ডকে দেওয়া ওই জমিতে মসজিদ ছাড়াও একটি বিনামূল্যের ক্যান্সার হাসপাতাল, একটি কমিউনিটি ক্যান্টিন এবং ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধের স্মরণে একটি জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
“কিন্তু আমরা যত দ্রুত তহবিল পাবো বলে আশা করেছিলাম, তত দ্রুত পায়নি। তাই এবার আমরা তহবিল সংগ্রহের পদ্ধতি পরিবর্তন করেছি,” বলেন মি. হুসেন।
তিনি আরও বলেন যে, ফাউন্ডেশনের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে মসজিদের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলেও জানান তিনি। সূত্র: বিবিসি।
আপনার মতামত জানানঃ