আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী বা নির্বাচনপ্রিয় দল। দলটি নির্বাচনে হাজির হতে পছন্দ করে। নির্বাচনকে যতটা পারে নকল সুরের গানে হলেও, শব্দদূষণ চরমে নিয়ে গিয়ে হলেও আনন্দঘন ব্যাপার করে ছাড়ে, কিন্তু যেটাকে ভয় পায় সেটা হলো- ভোট।
বিষয়টা পরিষ্কার করি, নির্বাচন ও ভোটের মধ্যে আমরা পার্থক্য করছি। নির্বাচনটা যতটা প্রশাসনিক, সাংগঠনিক ব্যাপার ভোট ঠিক তা নয়। ভোট একটা ব্যক্তির নাগরিক অধিকার। গণতান্ত্রিক বা আধুনিক রাষ্ট্রে ভোট একটা অপরিহার্য উপাদান।
আওয়ামী আমলে এসে আমরা নির্বাচন দেখি, কিন্তু ভোট দেখি না। তারা কোনোমতে নির্বাচনের দিনটা পার করতে পারলেই মনে করে জিতে গেছি। কোনো কোনো বিজয় যে পরাজয়ের চেয়ে শতগুণ গ্লানির হতে পারে সেই বিষয়ে কোনো হুঁশ নেই। ভোটের দিন আসলে ভোটটাকে কন্ট্রোলে রেখে নির্বাচন করার একটা পথ, একদিনের পুলসিরাত পার হওয়ার একটা কৌশল বের করে নিলেই হবে। আর এইসব কৌশল বা কু-কৌশলকেই রাজনীতি মনে করা হয়।
আওয়ামী আমলের গত তিনটা নির্বাচনে আমরা দেখেছি, একটির চেয়ে অপরটি ভোটাধিকার হরণের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার একটি কৌশল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বালুর ট্রাক ছিল হিরো। বালুর ট্রাক দিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনকে আটকে রাখা হয় গুলশান অফিসে। সেবার বিনাভোটে ১৫৪ জন সংসদে গিয়েছেন। পরে আসলো ঐতিহাসিক ২০১৮ সালের নির্বাচন। কিন্তু এর আগেই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে নিয়ে যাওয়া হলো।
আওয়ামী লীগের ফর্মুলাতে বিএনপি নির্বাচনে গেল। নির্বাচনের আগে অনেক মূলা দেখানো হলো। অনেক আলাপ-সংলাপ হলো। অনেক আস্থার আশ্বাস দেয়া হলো। এবং নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হলো।
অবশেষে বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। বড় বড় সমাবেশ করে। নির্বাচনকালীন সকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। মানুষও সমর্থন দেয়। কিন্তু শেষে ২৮ অক্টোবরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও বিরোধী জোটের নেতাদের ওপর চলে আরেকদফা ক্র্যাকডাউন। জেলে বন্দি হন হাজার হাজার নেতাকর্মী। এবার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে বিএনপি ও বিরোধী জোট নিজেদের অহিংস অবস্থান পরিষ্কার করতে চায়। এবং ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জনকে সবচেয়ে সফল অসহযোগ আন্দোলন মনে করছে দলটি।
আমরা পেলাম- আমি, তুমি ও ডামি নির্বাচন। দেশের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রই ছিল ফাঁকা। কিন্তু এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন যখন সুখের দিবানিদ্রায় ছিল, তখন ভোট প্রয়োগের হার ২৭% থেকে একলাফে ৪১% এর বেশি হয়ে যায়।
যাহোক, পাবলিক বুঝতে পারে না ঘটনা আসলে কী ঘটেছে। তারা ভোট না দেয়ার পরেও এতো ভোটার যদি ভোট দিতে পারে তাহলে তাদের থাকা না থাকাটা আসলে ম্যাটারই করে না- এটা তারা পরিষ্কার বুঝতে পারেন।
বাস্তব চিত্র হলো, সব মিলিয়ে হয়তো ১০ ভাগ এর নিচে ভোট পড়েছে । কিন্তু এতো কম ভোট কেন পড়বে? নেতা-কর্মীরা সিল মারার দায়িত্বে থাকার কারণে নিজেদের কর্মীদেরও ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে দেখা যায় নাই বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। যাহোক এই তিনটা জাতীয় নির্বাচনের ভোটের চিত্র দেখে আমরা কি এটা এখন পরিষ্কারভাবে বলতে পারি না যে, আওয়ামী লীগ এমন একটা ম্যাকানিজম বা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যাতে দেশে কায়েম হয়েছে ভোটারবিহীন নির্বাচনের সংস্কৃতি?
স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদী শাসনের একটা মহড়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এই ধরনের ফ্যাসিবাদ কায়েমের ইনসট্রুমেন্ট বা উপকরণগুলো কি তা খতিয়ে দেখা হয় না। এক নম্বরের টুল হলো নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাধিকার থেকে জনতাকে সরিয়ে রাখা। ভোটাধিকার একজন নাগরিকের সভারেন পাওয়ার বা সার্বভৌম ক্ষমতা। সভারেন পাওয়ার বা নিরঙ্কুশ-সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে লম্বা তাত্ত্বিক আলাপ এই লেখায় দেয়ার সুযোগ নেই।
শুধু এটুকু বুঝলেই হবে যে, এটা এমন ক্ষমতা যার কোনো বিকল্প কিছু হয় না, কোনো কিছু দিয়ে এটাকে রিপ্লেস করা যায় না। এটা বিক্রয়যোগ্য বা ক্রয়যোগ্য নয়। এটা একটা ইউনিক বিষয়।
এই ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার থেকে জনতাকে দূরে রাখার মাধ্যমে রাষ্ট্র যে ধরনের সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জন করে তাতে সে সব কিছুর অর্থই পাল্টে দিতে পারে। কারণ- সেটা জনগণের প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার সমন্বয়ে গঠিত হয় নাই। এবং সেটা একটা মেকি বা ছদ্ম সার্বভৌম ক্ষমতা। যে কারণে এটাকে অবৈধ ক্ষমতা বলা হয়। এটা যখন জনগণের বিরুদ্ধে আইনের নামে প্রয়োগ করা হয় সেটা হয় আইনের বেআইনি ব্যবহার। অর্থাৎ সেটা হয় সন্ত্রাস।
ভোটবিহীনভাবে ক্ষমতায় থেকে গণতন্ত্র, অধিকার এমনকি আইনের সংজ্ঞাও পাল্টে নিতে পারছেন নিজেদের সুবিধা মতো। এর মূলে আছে ভোটাধিকার প্রয়োগের সার্বভৌম ক্ষমতা হারানোর বিষয়টি। এর ফলে সব অযৌক্তিকতাই যুক্তি হিসেবে হাজির হচ্ছে। কৌশলের নামে ক্রাইম করা হচ্ছে।
যারা এই সবকিছুকে কৌশল বলে চালিয়ে দিতে চান তারা এটা ভুলে যান- যে কোনো কৌশলেরও একটা নীতিগত দিক থাকে। নীতিহীন কৌশল মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য তৈরির জন্য যথেষ্ট। এই যে বিপুল মানুষকে নাগরিক অধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা শূন্য করে ফেলা হলো তার ক্ষতিটা কতো ভয়াবহ হতে পারে আমরা কি তা চিন্তা করে দেখেছি কখনো?
অনেক রাজনৈতিক পণ্ডিত মনে করেন, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন মানে ভোটাধিকার বিসর্জনের পথে হাঁটা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জনগণ তার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে বিরত থেকেছে। এর ফলে অপপ্রয়োগ রোধ করা গেছে কিন্তু আসল কাজটি বাকি রয়ে গেছে। সেটা হলো এই সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারটি অর্জন করা। মানে, এমন একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা স্থাপন করা যাতে এই সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগটি বিনা শঙ্কায় অর্জন করা যায়।
ভোটাধিকার। নাগরিকের কর্তৃত্বের সত্ত্বা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত। একক কোনো দলের জিম্মায় দেয়া যায় না। যারা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জনের জন্য লড়াই করবেন তারা জনতার সমর্থন পাবেন-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জনতার দিক থেকে এই আন্দোলন কেবল নির্বাচনে কারো অংশগ্রহণ করা না করা বা একটা দলের আন্দোলন সফল বা ব্যর্থ হওয়ার উপর নির্ভর করে না। বরং এই সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণ যাতে সবসময় সংরক্ষণ ও প্রয়োগ করতে পারে তার উপযোগী রাজনৈতিক-দার্শনিক বা মতাদর্শিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মাণ করতে পারার মামলা। এই পয়েন্টেই জনগণকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিরোধ ও ঐক্যের প্রশ্নটির মিমাংসা করা প্রয়োজন।
পরিস্কারভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আওয়ামী লীগের অধীনে গত দেড় দশকে এমন একটা ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে যাতে ভোটাধিকার বা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রশ্নটি একটা বায়বীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে অনেক গণতান্ত্রিক দেশেও এই কাজটি করা হয় আরও নিখুঁতভাবে। জনগণ ঠিকই ভোট দেয়। যেমন ভারত বা আমেরিকাতে ভোটচুরি করা বা জনগণকে ভোটদানে বিরত থাকার মাধ্যমে ভোটাধিকার হরণ করার ঘটনা ঘটে না। কিন্তু কৃত্রিম জনজোয়ার তৈরি করে অনেক সময় এই কাজটি করা হয় বিভিন্ন দেশে। আমাদের দেশেও দেখবেন নির্বাচনকে উৎসবমুখর বলে গর্বভরে প্রচার করা হয়। নগদ টাকা, খাবার, উপহার বিলি করা হয়। নির্বাচন কি ফূর্তি করার মৌসুম নাকি? এই যে ফূর্তির ঘূর্ণিজাল তৈরি করে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের মতো সিরিয়াস বিষয়টিকে একটা মাদকতার মধ্যে আটকে ফেলে বা তার চৈতন্যকে করাপ্ট করে এই ভোটকে অপাত্রে ভাগিয়ে নেয়া হয় এতেও ভোটের হক আদায় হয় না।
নাগরিকের কর্তৃত্বের সত্তার প্রয়োগ হতে হবে সজ্ঞানে, যৌক্তিক ও ননবায়াসড বা নিরপেক্ষভাবে। বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে এই ক্ষমতা প্রয়োগের শক্তি অর্জন ছাড়া, হুজুগে মেতে সিল মেরে দেয়ার মধ্য দিয়ে একটি জনগোষ্ঠির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না।
জোয়ার বা ট্রেন্ড যেদিকে সেদিকেই জনরায় ধাবিত হয়- এটাও ভোটাধিকার বা নাগিরকের সার্বভৌম ক্ষমতার অপপ্রয়োগের একটা প্রক্রিয়া। এই জন্য নির্বাচনে তারকাদের সেনসেশনাল ইমেজকে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে অনেক প্রিয় তারকাকে আমরা এই পদছায়ায় শামিল হয়ে ধন্য হতে দেখেছি।
অনেক সময় স্বাধীনভাবে ভোটদানের জিকির তুলে নির্বাচন করার আয়োজন দেখলে মনে হয়- এটা সিম্পল মার্কেটিং ও ম্যানেজমেন্টর সার্কাসে পরিণত হয়েছে। ক্যাম্পেইনিং এর মাধ্যমে এমনভাবে প্রচার চালানো হয় যে, বাজারে অনেকগুলা ব্র্যান্ড আছে আপনি কোন ব্র্যান্ডটা নিবেন তা ঠিক করার জন্য যা বলা সম্ভব সবই বলা হয়। প্রয়াত তাত্বিক প্রদীপ বসুর ভাষায় বলা যায়- ‘ রাজনীতি সংবাদমাধ্যম ও মার্কেটিং সফলতার ভিত্তিতে গঠিত হচ্ছে। রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসূচি পণ্যের মতো পরিবেশিত হচ্ছে।’
দার্শনিক কান্টের বিবেচনায় এনলাইটেন বা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মানে যে নিজের মাথা খাটিয়ে চিন্তা করতে পারে এবং সেই চিন্তার লজিক বা রিজনিং এর জন্য কারো উপর বা অন্য কোনো বিষয়ের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না হয়েই স্বাধীনভাবে যৌক্তিক উপায়ে নিজের বক্তব্য পেশ করতে পারে- তাকেই তিনি যুক্তিসিদ্ধ আলোকিত মানুষ মনে করেছেন।
তেমনিভাবে একজন ভোটারের ক্ষেত্রে আমরা কান্টের এই নীতির প্রয়োগ করতে পারি। এর বাইরে যা থাকে তা হলো নির্বাচন অনুষ্ঠানের নামে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ভোটাধিকার হরণের আয়োজন।
আপনার মতামত জানানঃ