“আমার জন্যই তুমি ভেসে যাও অশ্রুর শহরে, দগ্ধ হও অবর্ণনীয় যন্ত্রণায়, গিয়েছ অভিশপ্ত নগরে৷ ঐশ্বরিক শক্তি, পরম প্রজ্ঞা এবং প্রথম প্রেমের ভেতর আমার জন্ম৷ আমার আগে আর কিছুর অস্তিত্ব ছিলো না৷ তুমি আর আশায় থেকো না৷”
এই পঙক্তিগুলো ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতালিয়ান কবি দান্তে আলিঘিয়েরির বিখ্যাত কাল্পনিক মহাকাব্য ‘ডিভাইন কমেডি’ থেকে নেয়া।
তিনি এই মহাকাব্যে দোযখের বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, দোযখের প্রবেশদ্বারের উপরের অংশে একটা শিলালিপিতে এই পঙক্তিগুলো মুদ্রিত।
দান্তের জন্ম ১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৩২১ খ্রিষ্টাব্দে। ১৩০৮ খিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দ, এই সময়কালে তিনি এই মহাকাব্যটি লেখেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে মহাকাব্যের প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
কবি এতে চিরাচরিত খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের দোযখের বর্ণনা দেন। কবির বর্ণনা অনুযায়ী, দোযখ হল এমন একটি ভয়ানক জায়গা, যেখানে পাপীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হয়।
তবে, সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হল, বাইবেলে ‘শাস্তি এবং নির্যাতনের’ স্থান হিসেবে দোযখের কথা অতি সামান্য-ই উল্লেখ করা হয়েছে।
বরং, দোযখের যে বর্ণনাটা আজ আমরা জানি, তা মূলত অনেক ইতিহাস এবং কিংবদন্তীদের মতাদর্শের সংমিশ্রণ। এটি মিশরীয়দের পরকালের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুরু করে গ্রীকদের হেডিসের ধারণা এবং এমনকি ব্যাবিলনীয়দের প্রতিষ্ঠার পৌরাণিক কাহিনী পর্যন্ত বিস্তৃত।
গ্রীক পুরান অনুযায়ী, হেডিস হলো মৃতদের ঈশ্বর। সেই সাথে, হেডিস হলো আন্ডারওয়ার্ল্ড, অর্থাৎ পাতাল বা মৃত্যু-পরবর্তী স্থানের রাজা।
“দোযখ হল এমন একটি স্থান, যা আগুন ও দানবে পরিপূর্ণ এবং যেখানে পাপীদেরকে শাস্তি দেয়া হয়; এটি সম্পূর্ণভাবে ইহুদী-খ্রিস্টানদের সংস্কৃতি থেকে এসেছে। এটি তৈরি হয়েছে আসলে মধ্যপ্রাচ্যের নানা লোকগাঁথা, ধারণা এবং বিশ্বাস থেকে।”
দোযখ সম্বন্ধে এমনটাই বলেন কলম্বিয়ার সান বুয়েনভেন্তুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ এবং ধর্মতত্ত্ববিদ হুয়ান ডেভিড টুবোন কানো।
টুবোনের মতে, দোযখ হল এমন এক ধারণা বা বিশ্বাস, যা অন্যান্য ধর্ম বা সংস্কৃতিতেও আছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানদের ধারণা থেকে তা অনেকটাই আলাদা।
“উদাহরণস্বরূপ, কলম্বিয়ার মুইসকাদের জন্য আন্ডারওয়ার্ল্ড (পাতাল) ছিল একটা সুন্দর স্থান। তারা এটিকে ‘পান্নার রঙের মতো সবুজ’ জায়গা হিসাবে বর্ণনা করে।”
অনেক বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায় ‘মুইসকা’ নামক এক আদিবাসী গোষ্ঠী ছিল। এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে দোযখের ধারণা যুগ যুগ ধরে পরিবর্তিত হয়েছে। সেইসাথে, এটিকে বারংবার লিপিবদ্ধ করা আজও অব্যাহত রয়েছে।
দোযখের ব্যাখ্যা বা ধারণা এত বেশি পরিবর্তনশীল যে ক্যাথলিক চার্চের প্রধান বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস মাত্র কয়েক বছর আগে দোযখের একটা ধর্মতাত্ত্বিক পর্যালোচনা করেছেন।
“সত্য হল, আত্মাদের শাস্তি দেয়া হয় না। কেউ যদি অনুতপ্ত হয়, তবে সে ঈশ্বরের ক্ষমা পায়। এবং, যারা সর্বদা ঈশ্বরের কথা ভাবে, অনুতাপকারীরা তাদের সারিতে স্থান পায়।”
২০১৮ সালে সাংবাদিক ইউজেনিও স্কালফারি’র সাথে এক আলাপে এ কথা বলেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি আরও বলেন, “যারা অনুশোচনা করে না এবং ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নন, তারা অদৃশ্য হয়ে যান। এসব অপরাধী চিত্তের জন্য কোনো দোযখ নাই। তাদের জন্য একটাই শাস্তি, গায়েব করে দেয়া।”
যদিও, পরে ভ্যাটিকান উল্লেখ করেছে যে ফ্রান্সিসকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করেছে সাংবাদিক। সাংবাদিক যা লিখেছেন, তাতে হুবহু তার বক্তব্য ছিল না।
সহস্রাব্দের নির্মাণ
“চার্চের শিক্ষা দোযখের অস্তিত্ব এবং অনন্তকালকে স্বীকৃতি দেয়। যারা মনের ভেতরে পাপ রেখে মৃত্যুবরণ করেন, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের আত্মাকে দোযখের ‘অনন্ত আগুনে’ পাঠানো হয় এবং সেখানে তারা নরকযন্ত্রণা ভোগ করে।”
ক্যাথলিক চার্চের ক্যাটিসিজমে দোযখকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।কিন্তু এই ধারনা কিভাবে এলো যে মৃত্যুর পর মানুষকে দোযখ নামক এক স্থানের ‘অনন্ত আগুন’ ভোগ করতে হবে?
টোবোন বলেন– মানুষ যখন মহাবিশ্বকে অনুভব করতে শুরু করে এবং বিশ্বে চলমান নানা ধরনের বিশৃঙ্খলাকে ব্যাখ্যা করতে পারেনা, ঠিক তখন থেকে দোযখের ধারণাটি তৈরি হয়।
“মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করলে ঝড়, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ লক্ষ্য করা যায় এবং তখন মানুষ এগুলোর সাথে আন্ডারওয়ার্ল্ড বা পাতালের সংযোগ খুঁজে পায়।”
এই ধরনের মিশরীয় এবং মেসোপটেমীয় সভ্যতার যুগে পরকালের বিশ্বাসের সংমিশ্রণে শেষ হয়। পরবর্তীতে, প্রাথমিকভাবে হিব্রুরা তা গ্রহণ করেছিল।
“মৃতরা যেখানে যায়, হিব্রু বাইবেলের প্রথম সংস্করণে তার নাম হল শেওল। কিন্তু এটা এমন এক জায়গা, যেখানে মৃতরা গেলেও কিছুই হয় না।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের গর্ডন-কনওয়েল থিওলজিক্যাল ইনসটিটিউটের নিউ টেস্টামেন্টের (বাইবেলের দ্বিতীয় ভাগ) অধ্যাপক শন ম্যাকডোনাফ এমনটা ব্যাখ্যা করেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে এই বিশ্বাসের সাথে আরও একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে, যার নাম হলো– গেহেনা এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্টিশন (বিষয়)।
“আস্তে আস্তে শেওলের চিরাচরিত ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। মৃতদের জায়গা থেকে এটি একটি অস্থায়ী জায়গা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল,” এই শিক্ষাবিদ বলেন।
তিনি আরও বলেন, “যেসব মানুষ জীবিত অবিস্থায় ধার্মিক ছিলেন এবং নিয়ম পালন করেছিলেন, মৃত্যুর পরে তারা ঈশ্বরের কাছাকাছি যান। আর যারা ধর্ম মানেন নি, তাদেরকে শুদ্ধিকরনের উদ্দেশে আগুনের মাঝে পাঠানো হয়; যা গেহেনা নামে পরিচিত।”
পাতাল এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবন বা পরকালের অন্যান্য বিশ্বাসগুলোর কিভাবে জন্ম হলো, তা ব্যাখ্যা করার জন্যই মূলত এই ‘গেহেনা’ প্রসঙ্গের অবতারণা।
“ইহুদীবাদ এবং অন্যান্য ধর্মের মাঝে অন্যতম তফাৎ হল, তারা বলে যে ঈশ্বর তাদের সাথে একটি মিত্রতা করেন এবং সেটা করেন একটা আইনের মধ্য দিয়ে। সেই আইনে মোট দশটি আদেশের কথা রয়েছে,” ব্যাখ্যা করেন টোবন।
তিনি বলেন যে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে দুই ধরনের পরিণতি আছে। “এটি ‘ঐশ্বরিক’ পুরস্কার এবং শাস্তির ধারণা তৈরি করে। যারা আইন মানেন, তারা পুরস্কৃত হবেন এবং যারা মানবেন না, তারা শাস্তি পাবেন। অন্য সংস্কৃতিতে এটা এতটা স্পষ্ট ছিল না।”
ম্যাকডোনাফের মতে, দোযখকে শাস্তির স্থান হিসেবে সবচেয়ে বেশি আখ্যা দিয়েছেন স্বয়ং যিশু এবং তিনি বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কয়েকবার গেহেনার কথাও উল্লেখ করেছেন।
“যিশু সেই ‘অগ্নিকুণ্ডের’ কথাও উল্লেখ করেছেন, যেখানে দুষ্টরা দুঃখ ও হতাশা ভোগ করবে এবং যেখানে কান্নাকাটি ও ভয়ংকর ক্রোধ থাকবে,” ম্যাকডোনাফ যোগ করেন।
“এই শব্দগুলো মূলত দোযখের ধারণার ভিত্তিপ্রস্তর, যা আমরা মধ্যযুগে দেখতে পাই এবং এই বিশ্বাস আজ পর্যন্ত অব্যাহ রয়েছে।”
দান্তের নরক ভ্রমণ
গ্রীক এবং হিব্রু ভাষা থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করার সময় ‘হেল’ বা ‘দোযখ’ শব্দটি ল্যাটিন ভাষায় অনুপ্রবেশ করেছে, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
ল্যাটিন ভাষায় এই শব্দটি ব্যবহারের কারণ, শেওল এবং হেডিসের মতো শব্দগুলোকে প্রতিস্থাপন করা। এই শব্দগুলো দিয়ে মূলত আন্ডারওয়ার্ল্ডকেই বোঝানো হয়।
টোবোন এটা স্পষ্ট করেছেন যে খ্রিস্টানরাই সর্বপ্রথম গ্রীক চিন্তাধারার সাথে যুক্ত হওয়া শুরু করেছিল। ঐ সময় খ্রিষ্ট ধর্ম ছিলো একদম-ই নতুন এবং তা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছিলো।
“মানুষ দেহ এবং আত্মার সমন্বয়ে গঠিত। সেই সাথে মৃত্যুর পর আত্মাদেরকে কোথাও একটা যেতে হবে, এই প্লেটোনিক ধারণা সর্বপ্রথম তুলে আনে তারাই,” তিনি বলেন।
এরপর, ষষ্ঠ শতকের সময় একটা ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা শুরু হয়। সেখানে উঠে আসে, দোযখ হল এমন এক জায়গা যেখানে অনুতপ্ত আত্মারা অনন্তকালের জন্য শাস্তি ভোগ করে।
ম্যাকডোনফ বলেছেন, “এটা অবশ্যই স্পষ্ট করা উচিৎ যে ধর্মতত্ত্ববিদদের জন্য প্রধান শাস্তি ঈশ্বরের কাছাকাছি যেতে না পারা। আগুন বা নির্যাতন, এগুলো প্রতীকী জিনিস।”
এবং, চৌদ্দ শতকে ইতালীয় কবি দান্তে আলিগিয়েরি যখন তার ‘ডিভাইন কমেডি’ প্রকাশ করেছিলেন, তখন ভয়াবহতায় ভরা একটি জায়গার সেই বর্ণনা সার্বজনীন হয়ে ওঠে।
“বিষয়টি এমন নয় যে দোযখ কেমন, দান্তে তা সংজ্ঞায়িত করেছেন। বরং, তিনি এই জায়গা সম্পর্কে সেই সময়ে বিদ্যমান সমস্ত ধারণাগুলিকে একটি নিপুণ উপায়ে একত্রিত করেছেন। বলা যায়, তিনি সবার মাঝে এই বিশ্বাসকে বপন করে দিয়েছিলেন যে দোযখ হলো এমন একটি স্থান, যেখানে গেলে চিরকাল যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়,” টোবোন বলেন।
কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসীদের আচরণ এবং বিভিন্ন ধর্মের ব্যাখ্যার কারণে সময়ের সাথে সাথে দোযখের সংজ্ঞা রূপান্তরিত হয়েছে। “দোযখ বলতে কেবল ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে থাকা বা ঈশ্বরের অনুপস্থিতি বোঝায় না এখন আর; বরং এটি একটা অনন্ত শাস্তি এবং কষ্টের জায়গা,” তিনি যোগ করেন।
অন্যান্য ধর্মে ‘দোযখ’
একাডেমিশিয়ানদের মতে, অনেক ধর্ম এবং সংস্কৃতিতে আন্ডারওয়ার্ল্ড বা পাতাল শাস্তির স্থান নয়, বরং আত্মাদের বিশ্রামের জায়গা হিসেবে বিবেচিত।
উদাহরণস্বরূপ, বৌদ্ধধর্মে নারাকা নামে পরিচিত একটি স্থান রয়েছে। এটি সংসারের ছয়টি রাজ্যের একটি। পার্থিব প্রস্থানের পরে আত্মারা এখানে অবস্থান করে। এটিকে পাতাল বা যন্ত্রণার জায়গা হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এটি কোনও স্থায়ী স্থান নয়, ক্ষণস্থায়ী স্থান।
ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে কোরআনে বিভিন্ন সময়ে ‘আগুনের স্থান’ শব্দদ্বয় এসেছে। এর অর্থ হলো, জাহান্নাম বা নরক। এই ধর্ম অনুসারে, মৃত্যুর পর অবিশ্বাসী আত্মারা জাহান্নামে যাবে।
“যেখানে শয়তান বাস করে, সেটাই মূলত শাস্তিদায়ক স্থান। পশ্চিমা সংস্কৃতিগুলোতে শাস্তির স্থান বলতে এমনটাই বেশি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তবে এর অন্যান্য সংস্করণও রয়েছে। যেমন– মিশরীয়, অ্যাজটেক, মুইসকাসদের ধারণা ভিন্ন ছিল,” বলেন টোবন।
তিনি জিবালবা’র উদাহরণ দেন। জিবালবা শব্দের অর্থ হলো ‘ভয়ের জায়গায়’। এছাড়া, জিবালবা হলো মায়ান আন্ডারওয়ার্ল্ড, যা সেনোটস নামে পরিচিত। বিশাল এক জলকূপের মাধ্যমে সেখানে পৌঁছাতে হয়।
“এটি আন্ডারওয়ার্ল্ড, যেখানে অনেক যন্ত্রণা আছে। তবে এটি কোনও দেবতার আইন মেনে চলায় ব্যর্থ হওয়ার শাস্তি নয়। বরং, এটি এমন জায়গা, যেখানে সমস্ত মানুষকে মৃত্যুর পরে অবশ্যই যেতে হয়,” তিনি ব্যাখ্যা করেন।
আপনার মতামত জানানঃ