অধিকৃত পশ্চিম তীরের বেথলেহেমের একটি বাড়ি। এই বাড়িতে মায়ের পাশে বসে চোখ ডলে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করছিল ইয়াজেন আলহাসনাত।
প্রায় পাঁচ মাস আগের এক ভোরে অভিযান চালিয়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সী এই ছেলেটি বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েলি সৈন্যরা। সম্প্রতি হামাসের সাথে জিম্মি বিনিময়ের সময় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
ইয়াজেনের আটকের ঘটনাকে “প্রশাসনিক কারণে আটক” বলা হয়েছিল, যেটি মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কাউকে আটকের সময় ব্যবহার করে থাকে ইসরায়েল।
এটি ছিল পুরনো একটি ব্রিটিশ আইন, যেটি উত্তরাধিকার সূত্রে দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে ইসরায়েল। এই আইনের অধীনে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই একজন ব্যক্তিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাবন্দী করে রাখতে পারে ইসরায়েল।
“তাদের কাছে একটি গোপন ফাইল রয়েছে। কিন্তু তারা আপনাকে বলবে না সেটিতে কী আছে,” গণমাধ্যমকে বলছিল ইয়াজেন। গত ৭ই অক্টোবর হঠাৎ হামলা চালিয়ে হামাস যেসব ইসরায়েলি নাগরিককে জিম্মি করেছিল, তাদের ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে কিছুদিন আগে ১৮০ জন ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল। ঐসব নারী ও শিশুকে দিনের পর দিন বিনা অপরাধে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছিল।
কিন্তু এমন এক সময়ে তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হলো, যখন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে ইসরায়েল।
গত ৭ই অক্টোবরের পর থেকে অন্তত ১৩০০ ফিলিস্তিনিকে “প্রশাসনিক আটক” করা হয়েছে, যেটি গত ত্রিশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে এই আইনের আওতায় দুই হাজার আটশরও বেশি ফিলিস্তিনি এখন ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী রয়েছে।
ইয়াজেনকে যখন মুক্তি দেওয়া হয়, তখন তার পরিবারকে সতর্ক করা হয়েছিল এই বলে যে, তারা যেন কোনভাবেই প্রকাশ্যে কোন উদযাপন না করে বা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলে।
একই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল আরও দুই কিশোরের পরিবারকে, যারা গণমাধ্যমর সঙ্গে কথা বলেছেন। এই তিনটি পরিবারই জানিয়েছে যে, তারা “প্রশাসনিক কারণে আটক” এর বিষয়টি সবার সামনে তুলে ধরতে চায়।
ইসরায়েল বলেছে যে, তাদের এই আইনের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োজনীয় একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সামরিক বিচার ব্যবস্থার সাবেক পরিচালক মরিস হিরশ গণমাধ্যমকে বলেন, ”আটক হওয়া ফিলিস্তিনিদের আপিলের সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি প্রতি ছয় মাস পর পর তাদের বন্দী দশার বিষয়টি পর্যালোচনা করার মাধ্যমে ইসরায়েল কেবল আন্তর্জাতিক আইনই মানছে- তা নয়, বরং সেটিকে ছাড়িয়েও গেছে।”
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েল যেভাবে আইনটির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদেরকে আটক করছে, সেটি আসলে অপব্যবহারে পর্যায়ে চলে গেছে। তাছাড়া আটক হওয়া ব্যক্তিরা নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ বা কার্যকরভাবে আপিল করার সুযোগ খুব একটা পায় না।
কারণ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য যে ধরনের তথ্য-প্রমাণ দরকার হয়, সেটি সংগ্রহ করার অনুমতি তাদের নেই।
“আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ‘প্রশাসনিক কারণে আটক’ একটি বিরল ব্যতিক্রম হওয়া উচিত,” বলেন হ্যামোকেডের নির্বাহী পরিচালক জেসিকা মন্টেল।
‘হ্যামোকেড’ ইসরায়েলের একটি মানবাধিকার সংস্থা, যারা আটক হওয়া ফিলিস্তিনিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে থাকে।
“আপনার উচিৎ এটি কেবল তখনই ব্যবহার করা, যখন আপনি চরম বিপদ থাকবেন এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করা ছাড়া সেই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্য কোন উপায় নেই৷ কিন্তু এটি স্পষ্ট যে, ইসরায়েল একে সেভাবে ব্যবহার করছে না৷ তারা হাজার হাজার মানুষকে বিনা অভিযোগে আটক করছে এবং নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রশাসনিক কারণে আটকের কথা বলছে।” বলেন জেসিকা মন্টেল।
ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৫ সাল থেকেই প্রশাসনিক কারণে আটক আইনের ভুক্তভোগী। প্রথমে ব্রিটিশদের অধীনে এবং পরে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে।
অতীতে আইনটি খুব বিরল কিছু ক্ষেত্রে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এখন এটি শিশুসহ পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের আটক করার ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রশাসনিক বন্দীদের শুনানির অনুমতি দেওয়া হয় সামরিক আদালতে, একজন ইসরায়েলি সামরিক বিচারকের সামনে। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আটককৃত ব্যক্তি বা তাদের আইনজীবীদের কাছে আটকের স্বপক্ষে কোন তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ করার প্রয়োজন হয় না। এরপর আটক হওয়া ব্যক্তিদের ছয় মাস পর্যন্ত সাজা হতে পারে।
তবে সামরিক আদালত চাইলে এই ছয় মাসের সাজা অনির্দিষ্টকালের জন্যও বাড়াতে পারে। অর্থাৎ এই আইনে বন্দী হওয়া ব্যক্তিরা ঠিক জানেনও না যে, তারা কতদিন বন্দী থাকবে।
“আপনি যেটি বুঝতে পারবেন, সেটি হচ্ছে অনিশ্চয়তা। আপনি কি আপনার ছয় মাসের কারাভোগ শেষে মুক্তি পাবেন? নাকি আপনার সাজা এক বা বছরের জন্য বাড়ানো হবে?” বলছিলেন ইয়াজেন।
বন্দীরা ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আপিল করতে পারে, কিন্তু তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণের কোন অনুমতি নেই।
ফলে ইসরায়েলি সামরিক আদালতে বিচার হওয়া এমন ফিলিস্তিনিদের মধ্যে মোটামুটি ৯৯ শতাংশই দোষী সাব্যস্ত হয়।
এ বিষয়ে জেরুজালেম-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা আইনজীবী মাহের হান্না গণমাধ্যমকে বলেন, “সামরিক আদালতে ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।”
তিনি আরও বলেন, “পুরো ব্যবস্থাটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যা একজন ফিলিস্তিনির আত্মরক্ষার ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। এটি প্রতিপক্ষকে একদিকে যেমন কঠোর সীমাবদ্ধতার মধ্যে ফেলে দেয়, তেমনি রাষ্ট্রপক্ষকেও প্রমাণ সংগ্রহ করার ঝামেলা থেকে মুক্তি দেয়।”
গণমাধ্যমর সাথে কথা বলার সময় ইয়াজেনের মা সাদিয়াহ বলেন, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের এই নীতির ব্যবহার “সব রেখা অতিক্রম করেছে- লাল, সবুজ, প্রতিটি রঙ।”
১৬ বছর বয়সী ওসামা মারমেশকেও একই আইনে আটক করা হয়েছিল। গণমাধ্যমকে সে বলছিল যে, যখন তাকে আটক করা হয়েছিল, তখন তাকে রাস্তা থেকে টেনে হেঁচড়ে একটি নম্বরবিহীন গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
ওসামাকে আটকের প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার বাবা নায়েফের কোনো ধারণাই ছিল না যে, তাঁর ছেলে কোথায়?
“আপনি আপনার পরিচিত সবাইকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করুন যে তারা আপনার ছেলেকে দেখেছে কি-না। আপনার চোখে ঘুম নাই,” বলেন নায়েফ।
আটক হওয়ার সময় ওসামা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে বারবার জিজ্ঞাসা করেছিল। এর জবাবে তাকে প্রতিবারই “চুপ” করতে বলা হয়েছিল।
অন্যদিকে, ১৭ বছর বয়সী আরেক কিশোর মুসা অ্যালোরিদাতকে যখন আটক করা হয়েছিল, ইসরায়েলি সৈন্যরা তার অন্য দুই ছোট ভাইকে আলাদা করে ফেলে এবং ঘরে থাকা একটি ওয়ারড্রোবে গুলি করে কাঁচ ভেঙে ফেলে।
“তিন দিন পর্যন্ত আমরা কিছুই জানতাম না।” বলছিলেন মুসার বাবা মুহান্নাদ। বন্দী থাকা অবস্থায় ইয়াজেন, ওসামা, মুসা, তাদের বাবা-মা কিংবা আইনজীবী- কাউকেই আটকের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ দেখানো হয়নি।
তবে সাম্প্রতিক জিম্মি বিনিময়ের সময় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, সেখানে অভিযোগের বিবরণের কলামে ইয়াজেন, ওসামা এবং মুসার নামের পাশে অস্পষ্টভাবে একটি লাইন লেখা ছিল। লাইনটি হচ্ছে: “এলাকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি।”
তালিকার অন্য আরেকটি সংস্করণে অবশ্য বলা হয়েছে যে, ইয়াজেন এবং মুসা ফিলিস্তিনি স্বশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ওসামাকে যখন মুক্তি দেওয়া হয়, তখন তাকে একটি সংক্ষিপ্ত চার্জশিট দেওয়া হয়।
সেখানে বলা হয় যে, দুই মাস আগে সে ইসরায়েলি নিরাপত্তা অবস্থানকে লক্ষ্য করে “তার হাতের তালুর অর্ধেক” আকারের একটি পাথর নিক্ষেপ করেছিল।
সামরিক বিচার ব্যবস্থার সাবেক পরিচালক মরিস হিরশ এ ব্যাপারে বলেন যে, অল্পকিছু তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোন সিদ্ধান্তে আসাটা ভুল হবে।
তিনি বলেন, “এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবে প্রমাণ দেখানো এবং গোয়েন্দা তথ্য থাকার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা গুয়ানতানামোতে আমেরিকানদেরকে ‘প্রশাসনিক কারণে আটক’ আইন ব্যবহার করতে দেখি। তাই আমরা জানি যে এই ব্যবস্থা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং গৃহীত। আর যেহেতু এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যবস্থা, কেন শুধুমাত্র ইসরাইলকে এটি ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা হবে, বিশেষত: যখন আমরা সম্ভবত সর্বোচ্চ সন্ত্রাসী হুমকির মোকাবিলা করছি যা আগে কেউ কখনও দেখেনি?”
ইয়াজেন, ওসামা এবং মুসাকে চার থেকে সাত মাস ইসরায়েলি কারাগারে কাটাতে হয়েছে। তারা তিনজনই বলেছিল যে, গত ৭ই অক্টোবরের আগে পর্যন্ত পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। কিন্তু এরপর হামাসের হামলার শাস্তি হিসেবে তাদের বিছানার চাদর, কম্বল, জামা-কাপড় এবং খাবারের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বহির্বিশ্বের সাথেও সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।
আটক হওয়া অন্য কয়েক জন ব্যক্তি আরও অভিযোগ তুলেছেন যে, ধরে নেওয়ার পর তাদেরকে মারধর করা হয়েছে, টিয়ারগ্যাস ছোঁড়া হয়েছে, এমন কি তাদের উপর কুকুরও লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলি কারা কর্তৃপক্ষ অবশ্য এটা নিশ্চিত করেছে যে, হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় তারা কারাগারগুলোকে জরুরী অবস্থা জারি করেছিলেন এবং সেখানে “নিরাপত্তা বন্দীদের সুবিধা সীমিত করা হয়েছিল।”
ইয়াজেন, ওসামা এবং মুসা বেশ তাড়াতাড়িই মুক্তি পেয়েছে বলা চলে, কারণ ইসরায়েলি জিম্মিদের বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মধ্যে যারা নারী ও শিশু, তাদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে কারা কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, ইসরায়েলি কারাগারে এখনও ২,৮৭৩ জন ফিলিস্তিনি বন্দী রয়েছেন, যাদেরকে প্রশাসনিক কারণে আটক করা হয়েছে।
কারামুক্তি পেয়ে বাড়ি ফেরার পর মুসা তার ঘরে গিয়েছিল, যেখানে চার মাস আগে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাকে তার বিছানা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
বুলেটের আঘাতে ভেঙে যাওয়া ওয়ারড্রোবের কাঁচ ততোদিনে সারানো হয়েছে। তার বাবা-মা সাবধানেই ঘরটিকে আগের মত গুছিয়ে রেখেছিলেন। যদিও মুসা বলছিল যে, আরও অনেক দিন তাকে কারাগারে থাকতে হবে বলে মনে করেছিল সে। তার আইনজীবীও তাকে বলেছি যে, তার কারাভোগের মেয়াদ বাড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ।
ইয়াজেন, ওসামা এবং মুসা- তিন জনই বলেছিল যে, তারা স্কুল শেষ করার চেষ্টা করতে চায়।
“কিন্তু আবারও বন্দী হওয়ার হুমকির মধ্যে বেঁচে থাকাটা তাদের জন্য এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক আটক”, বলছিল মুসা। আর ইয়াজেন গণমাধ্যমকে বলে, “ছোট কারাগার থেকে তারা আমাদের একটি বড় কারাগারে ছেড়ে দিয়েছে।” এই কথা শোনার পর ইয়াজেনের দিকে তাকিয়ে তার মা বলে ওঠে, “কোন শান্তি নেই। তারা যে কোন সময় তোমাকে আবারও ধরে নিয়ে যেতে পারে।”
আপনার মতামত জানানঃ