গত এক দশকে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় শয্যা সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। যদিও অঞ্চল অনুযায়ী চিকিৎসাসেবার চাহিদা মেটাতে পারছে না স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। অঞ্চলভিত্তিক জনসংখ্যা ও রোগ অনুযায়ী হাসপাতালের পর্যাপ্তসংখ্যক শয্যা নিশ্চিত করা যায়নি। এখনো দেশের ২০ জেলায় প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে হাসপাতালের গড় শয্যা সংখ্যা দুটিরও কম। গড়ে পাঁচটির বেশি শয্যা আছে মাত্র পাঁচ জেলায়।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্তসংখ্যক শয্যার অভাব। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একেকটি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সেবার পরিধি নির্ধারণ হয় মূলত হাসপাতালে শয্যা সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। রোগীর সংখ্যা এ শয্যা সংখ্যার অতিরিক্ত হলে গোটা প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা চাপে পড়ে যায়। সে জায়গায় হাসপাতালগুলোয় রোগী ভর্তি হচ্ছে শয্যা সংখ্যার অনেক বেশি। বিশেষ করে বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালগুলোয় এ চিত্র তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। শয্যা না পেয়ে অধিকাংশ রোগীকে চিকিৎসা নিতে হয় মেঝেতে বিছানা পেতে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অন্তত ২০টি জেলার প্রতি ১০ হাজার বাসিন্দার জন্য স্থানীয় হাসপাতালগুলোয় গড়ে দুটি শয্যাও বরাদ্দ নেই। গড় শয্যা সংখ্যা সবচেয়ে কম শেরপুর জেলায়। এ জেলায় ১ দশমিক ৩০টি শয্যার চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছে প্রতি ১০ হাজার মানুষ। লক্ষ্মীপুর জেলায় শয্যা রয়েছে ১ দশমিক ৪৪টি। পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে নরসিংদী (১ দশমিক ৪৯), হবিগঞ্জ (১ দশমিক ৫০), গাজীপুর (১ দশমিক ৫৬), সিরাজগঞ্জ (১ দশমিক ৫৮), চাঁপাইনবাবগঞ্জ (১ দশমিক ৬১), নাটোর (১ দশমিক ৬২), গাইবান্ধা (১ দশমিক ৬৩) ও চুয়াডাঙ্গায় ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ১ দশমিক ৬৬টি। এছাড়া আরো ১০টি জেলায় ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে গড় শয্যা সংখ্যা দুটির কম। জেলাগুলো হলো ভোলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট।
জনসংখ্যার অনুপাতে হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা জেলায়। এ জেলায় ২৮টি শয্যা রয়েছে প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে রাজশাহী (নয়টি) ও তৃতীয় খুলনা (আটটি) এবং ১০ হাজার জনসংখ্যার অনুপাতে ছয়টি শয্যা থাকায় চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বান্দরবান ও বরিশাল জেলা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে চিকিৎসা খাতের ব্যবস্থাপনায় অঞ্চলভিত্তিক জনসংখ্যার আকার ও তাদের রোগের ধরন এবং আক্রান্তের ক্রমধারা বিশ্লেষণ গুরুত্ব পায় কম। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। অন্যথায় ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে মানসম্মততা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোন দেশে কত জনসংখ্যার বিপরীতে হাসপাতালে কত শয্যা থাকা উচিত, তা ডব্লিউএইচও নির্ধারণ করে দেয় না। কারণ দেশ অনুযায়ী রোগের ধরন ও জনসংখ্যার আকার ভিন্ন। কোনো দেশে নির্দিষ্ট এলাকার জনসংখ্যার আকার ও রোগের ধরন অনুযায়ী ওই এলাকার হাসপাতালের শয্যা প্রস্তুত করতে হয়।
এসব ক্ষেত্রে সাধারণত নারী, পুরুষ, শিশু ও ষাটোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ও রোগ বিবেচনায় নিতে হবে। জেলাভিত্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিভাগ রোগের ধরন ও প্রকারভেদ দেখবে, একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থাকতে হবে। হাসপাতালে শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তির হার কেমন হবে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। ভর্তি রোগীদের কী কী চিকিৎসা প্রয়োজন তা হাসপাতালের পরিসর বৃদ্ধি বা নির্মাণের সময় বিবেচনায় নিতে হবে।’
এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, ‘উন্নত দেশগুলোয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্যমূলক ব্যবস্থাপনাগুলো শক্তিশালী হওয়ায় তাদের হাসপাতালে শয্যা থাকলেও বেড অকুপেন্সি রেট কম। বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নত দেশগুলোর তুলনা করলে চলবে না। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সাধারণত ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত রোগ কম হয়। তাদের রোগ প্রতিরোধের জায়গাগুলো এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারলে বড়সংখ্যক রোগী সৃষ্টি হবে না।
বাংলাদেশে হাসপাতালগুলোয় শয্যার তুলনায় রোগী বেশি হওয়ার কারণ দুর্বল ব্যবস্থাপনা। হাসপাতালভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে হলে একটি কার্যকরী রেফারেল ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে। যেটি হওয়া প্রয়োজন, মানুষ সব ধরনের চিকিৎসার জন্য শুরুতে উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাবে। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী রোগীকে মাধ্যমিক ও বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাতে হবে।’
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সারা দেশে সরকারের স্বাস্থ্যবিষয়ক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২১ হাজার ৪১১টি। এর মধ্যে রোগী ভর্তির সুবিধাসহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জেলা বা জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ সরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল আছে ৬৬০টি। দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৭ হাজার ৮৫৪ আর বেসরকারি রোগ নিরীক্ষা কেন্দ্র প্রায় ১০ হাজার। ব্লাড ব্যাংক আছে ১৮০টি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোয় ৬৮ হাজার ৩৯৫টি শয্যা রয়েছে। আর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৯০৬টি শয্যা। সব মিলিয়ে শয্যা সংখ্যা মোট ১ লাখ ৭৯ হাজারের কিছু বেশি। এ অনুযায়ী দেশের হাসপাতালগুলোয় মোট শয্যা সংখ্যার ৩৮ দশমিক ১৪ শতাংশই সরকারি প্রতিষ্ঠানে। গত এক দশকে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে শয্যা ছিল সাড়ে ৪১ হাজার আর বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা ছিল ৪৫ হাজারের কিছু বেশি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. সাইদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হাসপাতালে শয্যা বাড়ানো হয় মূলত হাসপাতালে শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তির হার অনুযায়ী। যেসব হাসপাতালে রোগী ভর্তি ১২০ থেকে ১৫০ শতাংশ হয় সেসব হাসপাতালে শয্যা বাড়ানো হয়। গত কয়েক বছরে প্রয়োজন অনুপাতে উপজেলা, জেলা ও বিশেষায়িত হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো হয়েছে। আর বেসরকারি হাসপাতালের শয্যা কত হবে তা ওই হাসপাতালের অনুমোদনের সময় দেখা হয়। পরে শয্যা বাড়ানোর আবেদন করলে তার সক্ষমতা বিবেচনা করা হয়।’
বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালগুলোয় শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তির হার সবচেয়ে বেশি বলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। সরকারের এ প্রতিষ্ঠান বলছে, দেশে বিশেষায়িত সব সরকারি হাসপাতালে শয্যার চেয়ে ৫৩ শতাংশ রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। এসব হাসপাতালে শয্যা আছে ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত। মোট শয্যার প্রায় ৪০ শতাংশ রয়েছে বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোয়। তবে রোগী ভর্তির হার এসব হাসপাতালে সর্বোচ্চ। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের হাসপাতালে শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তির হার ১৩৭ শতাংশ।
তবে শয্যার তুলনায় কম রোগী ভর্তি হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের হাসপাতালে। উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা তার নিচের পর্যায়ের হাসপাতালে ভর্তি হয় শয্যার বিপরীতে ৭৮ শতাংশ রোগী। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ৭৪ লাখ ৪৫ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ৬ কোটি ৬৩ লাখের বেশি ও জরুরি চিকিৎসার জন্য এসেছে ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি মানুষ।
ডব্লিউএইচও বলছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় হাসপাতাল কার্যকর ভূমিকা পালন করে। রোগীর তীব্র ও জটিল রোগ প্রশমন ও রোগমুক্তির অবিচ্ছিন্ন সেবা এসব প্রতিষ্ঠানের মৌলিক কাজ। জনগণের স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীতা অনুযায়ী দক্ষতার সঙ্গে সাড়া দেয়ার জন্য সুপরিকল্পিত রেফারেল নেটওয়ার্কের মধ্যে হাসপাতালগুলো কাজ করে। হাসপাতাল সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার অপরিহার্য উপাদান ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিশ্বের অনেক দেশে এ ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ও ঘাটতি রয়েছে। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা।
হাসপাতালভিত্তিক সেবার বিজ্ঞানসম্মত পর্যবেক্ষণ ও পরিসংখ্যান দেশে করা হয় না বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনার ঘাটতি। উপজেলা হাসপাতাল, জেলা বা জেনারেল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে আসা রোগীদের রোগ বিশ্লেষণ করা হয় না। হাসপাতালে কত রোগী এল, কী রোগ নিয়ে এল, রোগের পর্যায় কী ছিল তা বিশ্লেষণ থাকা উচিত।
এতে স্বাস্থ্যসেবা বণ্টনের বিষয়টি সুবিধাজনকভাবে পর্যালোচনা করা যায়। শুধু দেখা হয়, রোগী কত এল। এ বিশ্লেষণ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন। শয্যার বিষয়টি কোনো বিজনেস ডিমান্ডের বিষয় নয় যে কত চাহিদা ও কত শয্যা আছে। গোড়া থেকে পরিকল্পনা করে এগিয়ে নিতে হবে। আর কোথাও কোথাও সরকারি হাসপাতালগুলোয় শয্যা বাড়ানো হলেও তা হয়েছে কাগজে-কলমে। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য জনবল ও চিকিৎসাসামগ্রী। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় গলদ দীর্ঘদিনের। দেশে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি।’
আপনার মতামত জানানঃ