জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল যখন সংসদীয় আসনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে তখনও বিএনপি রয়েছে আন্দোলনের মাঠে। এ অবস্থায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ছাড়াই বাংলাদেশে আরেকটি ‘একতরফা নির্বাচন’ হতে যাচ্ছে বলেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিএনপি অংশ না নিলেও এবার জাতীয় নির্বাচনটি ২০১৪ সালের চেয়ে ‘ভিন্নভাবে’ করতে চাইছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ভোটার উপস্থিতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট করতে এবার নানা কৌশলেরও আশ্রয় নেবে আওয়ামী লীগ।
বিএনপি এবং তাদের আন্দোলনে সঙ্গীরা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিপক্ষে থাকলেও যথাসময়ে নির্বাচন শেষ করাই আওয়ামী লীগের মূল টার্গেট।
প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে আগামী নির্বাচনে ভোটের মাঠে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখানো এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটারকে কেন্দ্রে আনাটাই এখন আওয়ামী লীগের বড় লক্ষ্য।
বিএনপিকে ছাড়া একটি জাতীয় নির্বাচন কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক করা হবে? এ প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভোটার উপস্থিতি এবং বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণেই এ নির্বাচন হবে।
তিনি বলেন, “অবশ্যই একটা বড় দলের উপস্থিতি ইলেকশনটাকে কমপিটিটিভ করতো। সেটা যখন হয়নি তখন বিদ্যমান অবস্থায় আমাদের কাছে মনে হয় যে আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে যে উৎসাহ উদ্দীপনা আমরা এ নির্বাচনকে ঘিরে দেখতে পাচ্ছি, তাতে বড় ধরনের টার্নআউটের ব্যাপারে যে আশঙ্কা সেটি সত্য হবে না। টার্নআউট হবে এবং একটা ভালো ইলেকশন হবে। ভালো ইলেকশন হবে।”
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক দাবি করছেন, এবার নির্বাচনটি ভালো হবে তবে সেটি কীভাবে সে বিষয়টি তিনি পরিস্কার করেননি। তবে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং বিএনপির জোট ভেঙে কয়েকটি দলের নির্বাচনে আসার বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো একে একে নির্বাচনে আসছে। এসব দলকে তিনি নির্বাচনী ‘রাজনীতির মাঠে ফুল’ হিসেবে অভিহিত করেন।
ভোটের রাজনীতিতে এ দলগুলোকে সরকারি সমর্থনপুষ্ট এবং কৃত্রিম ফুল বলা হবে কি না?
এমন প্রশ্ন করা হলে মি. কাদের বলেন, “সরকারের সমর্থনে হচ্ছে বিষয়টা এমন নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে ফুল হিসেবে বললাম, তবে সব ফুলে কি আর সুগন্ধ থাকে?”
বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি ছাড়া একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ ও ‘ভালো নির্বাচন’ কীভাবে দেখানো যাবে সেটা আওয়ামী লীগের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ সরকার বিরোধী আন্দোলনে থাকা দলগুলোকেও দেখা যাচ্ছে নির্বাচনে আনার চেষ্টা হচ্ছে।
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বিবিসি বাংলাকে জানান, তার সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। তবে এই আলোচনার অনেক কিছুই মিডিয়ায় প্রকাশ করা যাবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার যুক্তি হিসেবে ইবরাহিম বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস নিয়েই তিনি ভোটের মাঠে নামছেন। “ওনারা আশ্বস্ত করেছেন যে আঠারো সালের নির্বাচনটা নিয়ে বিশাল একটা সমালোচনা আছে। সেটা সরকার তদন্ত করে পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করেছে যে এখানে সমালোচনা আছেই। আমরা ওই সমালোচনা চাই না।”
“তাহলে ওই সমালোচনা যেন পরিহার করা যায় তার জন্য যা করলে এটাকে গ্রহণযোগ্য বলা যায় তাই করবে তারা। আমি আশ্বস্ত হয়েছি বলেই এ সিদ্ধান্ত নিলাম। এখন সে ওয়াদা কতটুকু রক্ষা হবে এ গ্যারান্টি সরকার দেবে,” বলেন ইবরাহিম।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে কী কৌশল নিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সেটি নিয়েও রাজনীতিতে আগ্রহ রয়েছে। চলছে নানারকম আলোচনা।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আগামী নির্বাচনটিকে সিংহভাগ রাজনৈতিক দল ও ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ দেখাতে চায় সরকার।
তফসিল ঘোষণার পর পরই জোরেশোরে ভোটের মাঠে নেমে পড়েছে আওয়ামী লীগ। যেখানে একটা বড় লক্ষ্য বিএনপির আন্দোলনের বিপরীতে দেশে একটা ‘নির্বাচনী আমেজ’ সৃষ্টি করা।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে ৩০০ আসনের বিপরীতে তিন হাজার ৩শ ৬১ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খানের পর্যবেক্ষণে এবার বিএনপি নির্বাচনে না আসলেও নানা কৌশলে আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনকে একটি ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ হিসেবে হাজির করতে পারে বলে।
“প্রথমত বিএনপিতে একটা ভাঙন হতে পারে যারা নির্বাচনমুখী তাদেরকে নির্বাচনে আনার একটা চেষ্টা করতে পারে। এছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগেও বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়াতে পারে তাদেরকে হয়তো ছেড়ে দিল মাঠ। যে ঠিক আছে বিদ্রোহী বনাম মনোনয়ন যারা পেলেন দল থেকে তারা নির্বাচন করবেন। সে জায়গা থেকে একটু হলেও লড়াইয়ের নির্বাচন হতে পারে।”
“হতে পারে জাতীয় পার্টি যেটা এই মুহূর্তে আছে তাদেরকে একটা শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসা বিরোধী দল হিসেবে। অন্যান্য যে ছোট ছোট দল আছে তৃণমূল পর্যায়ে তাদেরকে সেন্টারে এক ধরনের জায়গা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে নিয়ে আসা বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করবে বলে আমার মনে হয়,” বলেন রাশেদা রওনক খান।
আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনে ছোটখাটো দলের অংশগ্রহণ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও বিএনপি যদি নির্বাচনে না অংশগ্রহণ করে তাহলে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন এবং পরবর্তীকালে বেশকিছু উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় সে জায়গায় কাজ করার প্রয়োজন দেখছে আওয়ামী লীগ।
কারণ বিএনপি ছাড়া ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো যায় কীভাবে সেটি আওয়ামী লীগের একটা বড় চিন্তার বিষয়।
এক্ষেত্রে সারাদেশে দলীয় এবং সহযোগী সংগঠনের সব নেতাকর্মীকে ভোটকেন্দ্রে আসা এবং তাদের আত্মীয় স্বজন পরিচিত ভোটারদেরকে উপস্থিত করার টার্গেট করছে আওয়ামী লীগ।
বিভিন্ন নির্বাচনের তথ্যে দেখা গেছে, প্রাচীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের একটা বড় ভোটব্যাংক রয়েছে। দলীয় সমর্থক ভোটারদের কেন্দ্রে আনার জন্য আগে থেকে সারাদেশে কেন্দ্র-ভিত্তিক কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে সারাদেশেই নির্বাচনী কেন্দ্র-ভিত্তিক কমিটি কাজ করবে আওয়ামী লীগের।
“যেমন আমার নির্বাচনী এলাকা সেখানে আমাদের কেন্দ্র-ভিত্তিক কমিটি আছে, তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের কমিটি আছে। আমরা কাজ করেছি, কাজ করে যাচ্ছি। এরকম সারা বাংলাদেশেই আওয়ামী লীগের কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। এবং আওয়ামী লীগের কর্মীরা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করবে। এইটাই আমাদের আশা, এইটাই আমাদের চিন্তা।”
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ বলছেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সব দলের অংশগ্রহণ চায় তবে বিএনপি না আসলেও নির্বাচন হবেই।
“নির্বাচন ছাড়া দল টিকে না। আমরা চাই বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। নির্বাচনে যদি কোনো দল না আসে সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা চাই সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।”
বাংলাদেশে এবার সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক একটা চাপ রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে না আসলে আবারো রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য অনেকটাই সহজ হয়।
আপনার মতামত জানানঃ