সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিএনপির সক্রিয় নেতা-কর্মীদের বেছে বেছে তাঁদের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটছে। নেতা-কর্মীদের না পেয়ে তাঁদের বাসায় ভাঙচুর ও লুটপাট করা হচ্ছে।
হামলার এই প্রবণতা শুরু হয় গত অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে। ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর হামলার ঘটনা বাড়তে থাকে। গত পাঁচ সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, যশোর, লালমনিরহাট, সিলেট ও ঢাকায় বিএনপির অন্তত ৯৩ জন নেতা-কর্মীর বাড়িতে হামলা হয়েছে।
বাড়ি বেছে বেছে হামলার পাশাপাশি গত দুই মাসে রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে অন্তত ১৮টি গুপ্ত হামলা হয়েছে। এতে নিহত হয়েছেন একজন। সেই সব ঘটনায় কোনো রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
বাড়ি বাড়ি যারা হামলা করতে যাচ্ছে, তাদের মুখোশ পরা থাকে। কোনো ক্ষেত্রে হেলমেট পরে, কোনো ক্ষেত্রে মুখ আড়াল না করেই হামলা হচ্ছে। কোনো ক্ষেত্রে ককটেল ছুড়ে পালিয়ে যাচ্ছে হামলাকারীরা।
যেমন নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি আবু মোহাম্মদ মাসুমের বাড়িতে তিন দফা হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাঁর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার কাছাকাছি। ১ নভেম্বর সকালে তাঁর বাড়িতে ‘ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা’ ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে তাঁর পরিবার।
ঘটনা এখানে শেষ হয়নি। একই দিন রাতে রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের এক নেতার নেতৃত্বে অন্তত ৫০ জনের একটি দল মাসুমের বাড়িতে আবার হামলা চালায়। এই ঘটনার একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, হামলাকারীরা মাসুমের বাড়ির ফটকে রামদা ও রড দিয়ে আঘাত করছেন।
একপর্যায়ে ফটক ভেঙে তাঁরা বাড়ির ভেতরে ঢুকে রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন; এমনকি শৌচাগারের কমোডও ভাঙচুর করেন। মাসুমের পরিবারের অভিযোগ, হামলাকারীরা আলমারি ভেঙে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করেছেন।
হামলার ঘটনার পর মাসুমের পরিবার রূপগঞ্জ ছাড়ে। তাঁরা রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। ১৪ নভেম্বর ভাড়া বাসায়ও ভাঙচুর চালানো হয়। তখন মাসুম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে একদল লোক তাঁর বাসায় ঢুকে ভাঙচুর করে।
বসুন্ধরার বাসায় হামলার ঘটনার তিন দিন পর কক্সবাজার থেকে মাসুমকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাসুম এখন কারাগারে।
তিন দফা হামলার ঘটনায় মাসুমের পরিবার পুলিশের কাছে যায়নি। বিএনপির নেতারাও কোনো অভিযোগ করেননি। তাঁরা মনে করেন, পুলিশের কাছে গিয়ে কোনো লাভ হবে না; বরং আরও হামলার আশঙ্কা তৈরি হবে।
পুলিশও স্ব–উদ্যোগে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারা অভিযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) গোলাম মোস্তফা রাসেল গত সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো হামলার তথ্য আমাদের কাছে নেই। ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগও করেনি।’ তিনি বলেন, ‘তথ্য পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
বিএনপির জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সক্রিয় নেতা-কর্মীরা বেশির ভাগই কারাগারে অথবা আত্মগোপনে। বাড়িতে থাকছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। সেখানে বেছে বেছে হামলার ঘটনা ঘটছে।
সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার সকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য কারাবন্দী মির্জা আব্বাসের বাসা লক্ষ্য করে দুটি ককটেল হামলা হয়। মির্জা আব্বাসের স্ত্রী ও জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস পরে সাংবাদিকদের বলেন, হেলমেট পরা দুজন এসে ককটেল ছুড়ে মারেন।
কিছুটা দূরে মোটরসাইকেলে আরও কয়েকজন ছিলেন। পুলিশ তাঁদের না ধরে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
অবশ্য পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, এটা তাঁর (আফরোজা) রাজনৈতিক বক্তব্য।
সিলেট সিটি করপোরেশনের বিএনপিদলীয় সদ্য সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বাসভবন লক্ষ্য করে গতকাল রাতে ককটেল হামলা হয়েছে।
কোথায় কত হামলা
বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলার ঘটনা বেশি ঘটছে নারায়ণগঞ্জে। জেলায় বিগত ৩৫ দিনে ৩১ দফায় বিএনপির অন্তত ৬৩ জন নেতা-কর্মীর বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন ১৫ নভেম্বর রাতে নোয়াখালীতে বিএনপির ১৪ জন নেতা-কর্মীর বাড়িতে হেলমেট পরে হামলা চালায় স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘হেলমেট বাহিনী’। এরপরের কয়েক দিনে বিএনপির আরও পাঁচ নেতা-কর্মীর বাড়িতে এবং একজনের মোটরসাইকেলের গ্যারেজে হামলা চালানো হয়।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিগত ২০ দিনে বিএনপির চার নেতার বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় একদল ‘মুখোশধারী’। রোববার লালমনিরহাটে দলের রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব ওরফে দুলুর বাসভবনে হামলা করে আগুন দেওয়া হয়, যেটি তিনি অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবেও ব্যবহার করেন। গত শনিবার হামলা হয় যশোরে বিএনপির প্রয়াত নেতা তরিকুল ইসলামের বাড়িতে। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে তরিকুলের বাড়ির ফটক লক্ষ্য করে মাত্র দেড় মিনিটে ২৫টি ককটেল ছুড়ে মারে মোটরসাইকেলে আসা যুবকেরা।
যশোরের অভয়নগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফারাজী মতিয়ার রহমানের বাড়ি লক্ষ্য করে গত বুধবার রাতে ককটেল ছুড়ে মারা হয়। একই উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মশিয়ার রহমানের বাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল হামলা হয় গত শুক্রবার গভীর রাতে।
হামলার এই প্রবণতা শুরু হয় গত অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে। ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর হামলার ঘটনা বাড়তে থাকে। গত পাঁচ সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, যশোর, লালমনিরহাট, সিলেট ও ঢাকায় বিএনপির অন্তত ৯৩ জন নেতা-কর্মীর বাড়িতে হামলা হয়েছে।
একটি মামলাও হয়নি
বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি হামলার একটি ঘটনায়ও মামলার খবর পাওয়া যায়নি। বিএনপির নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় এসব হামলা করছেন। পুলিশ তাঁদের কিছু বলে না; বরং বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি অভিযান চালানো হচ্ছে। সেখানে তাঁদের না পেলে স্বজনদের ধরে আনা হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ (৩৪ জন), সোনারগাঁ (১৩ জন), আড়াইহাজার (১১ জন), ফতুল্লা (৩ জন) ও সিদ্ধিরগঞ্জে (২ জন) নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলার পর একটি ঘটনায়ও স্বজনেরা মামলা করতে যাননি।
কারণ কী জানতে চাইলে আত্মগোপনে থাকা নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতে এ ধরনের ঘটনায় থানায় যাওয়ার পর পুলিশের আচরণে মনে হয়েছে আমরা এই রাষ্ট্রের নাগরিক নই। পুলিশের কাছে গিয়ে যেন অপরাধ করেছি।’ তিনি বলেন, এমনও হয়েছে পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না করে হামলার শিকার নেতা-কর্মীদেরই গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে।
‘লুটপাটও’ চলছে
কোনো কোনো ক্ষেত্রে হামলাকারীরা নগদ টাকা ও সোনাদানা লুট করছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আমানউল্যাহপুর ইউনিয়ন কৃষক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক বাহার উদ্দিন বলেন, গত শনিবার তাঁর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ও দুটি মুঠোফোন লুট করে নিয়ে যান স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ হামলা অথবা লুটপাটের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এদিকে রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র যুবদলের সহসভাপতি মো. আকরাম ও তাঁর ভাই বিএনপি নেতা মো. দুলাল আত্মগোপনে রয়েছেন। ২ নভেম্বর রাতে রামদাসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র হাতে ২০-২৫ জন যুবক আকরামের বাড়িতে হামলা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে লুটপাট চালায়।
ভুক্তভোগীদের দাবি, হামলাকারীরা দুই লাখ টাকা, আট ভরি স্বর্ণালংকার ও ৩৬০ জোড়া কবুতর নিয়ে গেছে। এমনকি সাতটি ভ্যানগাড়ি এনে আসবাবও নিয়ে যায় তারা। আকরামের বাড়িতে গতকাল গেলে পরিবারের সদস্যরা হাত জোড় করে বলেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চান না। পুলিশ এ ঘটনায়ও বলেছে, অভিযোগ পেলে তারা ব্যবস্থা নেবে।
আপনার মতামত জানানঃ