ভারতে পাচারের সময় মেহেরপুর সীমান্ত থেকে ৩৩ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। শনিবার সকালে মেহেরপুর সদর উপজেলার বুড়িপোতা সীমান্তে অভিযান চালিয়ে এসব ডলার উদ্ধার করা হয়।
এদিকে, তীব্র সংকটে ডলারের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। ডলার সংকট কাটাতে যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা সবই ভেস্তে যাচ্ছে। বাজারে দাম নিয়ে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মুদ্রাটির দাম। ডলারের দামের ওপর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাফেদা ও এবিবি’র ওপর ছেড়ে দেয়ার পর মুদ্রাটির দর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। ফলে খোলা বাজারে ডলারের দাম রেকর্ড সর্বোচ্চ ১২৮ টাকায় পৌঁছেছে। অনেক ব্যাংক ডলার পাচ্ছে না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতার সুযোগে প্রতিযোগিতা করে ১২৪ টাকা দরেও ডলার কিনেছে অনেক ব্যাংক। ডলার বাজারের এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা এবং নির্ধারিত দামে ডলার বিক্রিসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার এসোসিয়েশন (বাফেদা)। বৈঠকে জরুরি ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা চেয়েছেন বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি ও প্রধান নির্বাহীরা। দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ডলারের দাম নির্ধারণ করছে বাফেদা এবং এবিবি। তবে অনেক ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউজ নির্ধারিত দাম ডলার কেনা-বেচা করছে না। এ পরিস্থিতিতে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা চেয়েছে এবিবি ও বাফেদা।
২১ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহীরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে এবিবি’র চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, এবিবি ও বাফেদার সমন্বয়ে ৮ই নভেম্বর ডলার কেনাবেচার একটা রেট বেঁধে দেয়া হয়েছিল, সেই রেট অনুযায়ী প্রবাসী আয়ের ডলারে ১১৬ টাকার বেশি দিতে পারবে না। তবে আমদানিকারকদের কাছে ব্যাংকগুলোকে ১১১ টাকায় বিক্রি করতে হবে। এর বেশি নেয়া যাবে না। কেউ যদি এটা অমান্য করে তাহলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, ডলারের বাজার খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। স্থিতিশীল করার জন্য আমরা সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কাজ করছি।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেমিট্যান্সের ডলার কেনার ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় হওয়ার পর বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রেমিট্যান্সের ডলার কেনার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। প্রণোদনার নামে রেমিট্যান্সের ডলার ১২১ থেকে ১২৩ টাকা দরেও কিনছে কোনো কোনো ব্যাংক। বেশির ভাগই কিনছে ১১৪ থেকে ১১৬ টাকা করে। এতে ডলারে কেনার খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমদানিতেও প্রিমিয়াম এবং নানা ফির নামে বেশি দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে। আমদানির ডলার ১১১ টাকা করে বিক্রির কথা থাকলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১৪ থেকে ১১৭ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। এতে রপ্তানিকারকরাও আপত্তি করেছেন। তারা ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দরে এখন ডলার বিক্রি করতে চাচ্ছেন না।
জানা গেছে, করোনার পর অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অর্থপাচার ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় হুন্ডিতে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। এতে করে ডলারের দর হু হু করে বেড়ে গত বছরের মাঝামাঝি ১১৪ টাকায় ওঠে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় গত বছরের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দর ঠিক করে আসছে ব্যাংকগুলো। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শুরুতে ডলারের দর রেমিট্যান্সে ১০৮ এবং রপ্তানিতে ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে উভয় ক্ষেত্রে ডলার কেনার দর অভিন্ন করা হয়।
এদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ডলারের দর ঠিক করার পাশাপাশি রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এরইমধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছর বিক্রি করা হয় ১৩.৫৮ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছর ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার। এতেও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি।
রাজধানীর মতিঝিল ও দিলকুশা এলাকার একাধিক মানি চেঞ্জারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো এখন সর্বোচ্চ ১২৪ টাকা হারে বিদেশি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে রেমিট্যান্স ডলার কিনছে। তাদের আমদানিকারকদের কাছে এখন ১১১ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বেশ কয়েকটি ব্যাংক নির্ধারিত দরের চেয়ে ১০/১২ টাকা বেশি দামে ডলার কিনেছে। এমনকি খোলা বাজারের চেয়েও দুই থেকে পাঁচ টাকা বেশি দরে ডলার কেনার ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ব্যাংক ১২৩ থেকে শুরু করে ২২৪ টাকা দরে ডলার কিনেছে।
জরুরি বৈঠক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, গত ৬ মাসে এমন সমস্যা ছিল না; ডলারের দাম ১২৪ টাকা কখনো হয়নি। বাড়তি প্রণোদনা উন্মুক্ত করায় ডলারের বাজারে বিশৃঙ্খলা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সবধরনের সহায়তা করা হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
যারা বেশি দামে ডলার কিনেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, তাদের ১২ টাকা লোকসান দিয়ে ১১১ টাকায় ডলার বিক্রি করতে হবে এটাই তো বড় শাস্তি।
এদিকে খোলা বাজারে একদিনে ডলারের দাম ৫-৬ টাকা বেড়ে গেছে। মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১২৭ থেকে ১২৮ টাকায়। অথচ একদিন আগেও এর দাম ছিল ১২১-১২২ টাকা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত হার অনুযায়ী খুচরা বাজারে ডলারের দাম ১১৪ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
সরজমিন দেখা যায়, রাজধানীর বিজয় সরণিতে এক মানি চেঞ্জার এক গ্রাহককে বলছেন, বিক্রি করার মতো ডলার নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ডলার বিক্রি করতে চাই। কিন্তু আগে আমাকে ডলার পেতে হবে। ১২৩ থেকে ১২৪ টাকা প্রস্তাব দিলেও আমরা কোনো ডলার পাচ্ছি না। তাই বিক্রি করার মতো ডলার নেই।
এদিকে ডলার কিনতে গিয়ে অনেক গ্রাহক খালি হাতে ফিরেছেন। পল্টনে ডলার কিনতে আসা হাসিম বলেন, সিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হতো। তাই ডলার কিনতে এসেছি। কিন্তু এত দামে কেনা সম্ভব না। এ কারণে ফিরে যাচ্ছি।
মানি চেঞ্জার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এ কে এম ইসমাইল হক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দাম অনুযায়ী আমাদের ডলার কিনতে হবে ১১৩ টাকা ৫০ পয়সায়। আর বিক্রি করতে হবে ১১৫ টাকায়। কিন্তু এই দামে ডলার কেনা যায় না, বিক্রিও হয় না।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যান। প্রচুর শিক্ষার্থীও বিদেশে পড়াশোনার জন্য যান। আর পর্যটনের জন্যও ভ্রমণপিপাসুরা এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছুটছেন। এসব গ্রাহক খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে থাকেন।
নগদ ডলারের পাশাপাশি অনেকে বিদেশে গিয়ে কার্ডেও ডলার খরচ করে থাকেন। সম্প্রতি দেশে ডলার সংকটের কারণে নগদ ডলারের পরিবর্তে কার্ডের মাধ্যমে ডলার খরচের প্রবণতা বেড়েছে। কার্ডের মাধ্যমে খরচ করলে ব্যাংকগুলো প্রতি ডলারের দাম রাখে ১১৪ টাকা।
আপনার মতামত জানানঃ