বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর প্রশ্নটি কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যম ও রাজনীতির অঙ্গনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। কারণ, তাঁর শারীরিক অবস্থার ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। ৫০ দিনের চেয়ে বেশি সময় ধরে একটানা হাসপাতালে আছেন তিনি।
এ সময়ে একাধিকবার তাঁকে সিসিইউতে স্থানান্তর করা সত্ত্বেও তাঁর অবস্থার উন্নতি হয়নি। তাঁর চিকিৎসকেরা একজন রোগীর স্বাস্থ্য বিষয়ে সবাইকে যতটা অবহিত করতে পারেন, সম্ভবত তার সবটাই করেছেন।
খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন একাধিক সংবাদমাধ্যমকে যা জানিয়েছেন, সে অনুযায়ী, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে।
তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তাঁর স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এ কারণে তাঁকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে এবং কখনো কখনো তাঁকে সিসিইউতে নিতে হচ্ছে (প্রথম আলো অনলাইন, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।
চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, তাঁর চিকিৎসার জন্য যে ধরনের সুবিধা দরকার—যাকে তাঁর মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি সেন্টার বলছেন—তা বাংলাদেশে অনুপস্থিত।
খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়টি প্রায় দুই বছরে আগে থেকেই সময়ে সময়ে উঠে এসেছে। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে এবং তাঁর চিকিৎসকেরা এ বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার সুযোগ পেলেই অনুরোধ করে এসেছেন।
অনেকের স্মরণে থাকবে, ২০২১ সালের নভেম্বরে তাঁর স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতির প্রেক্ষাপটে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছিল।
সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। সেই সময়ে তাঁর চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে এবং সেগুলোয় নিয়ে যেতে পারলে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সম্ভব।
গত কয়েক সপ্তাহে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির মুখে যখন তাঁর চিকিৎসকেরা আবারও জোর দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার পরামর্শ দেন, সে সময়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২৪ সেপ্টেম্বর বলেছিলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো অনুরোধ আসেনি (আমাদের সময় ডট কম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।
অথচ পরিবারের সূত্রগুলো দাবি করে, তারা এই আবেদন করেছে ৪ সেপ্টেম্বর (মানবজমিন অনলাইন, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারের পক্ষ থেকে গত সোমবার আবারও আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে (বিবিসি বাংলা অনলাইন, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। ইতিমধ্যে দেশের বাইরে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি উঠেছে। গত ১২ জুন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে চিঠি দিয়েছেন।
দুই দিন ধরে এ-ও জানা যাচ্ছে, পরিবারের পক্ষ থেকে করা আবেদন সরকার ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করার ইঙ্গিত দিয়েছে এবং এ বিষয়ে আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ফাইল-চালাচালি হচ্ছে। তবে লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে এই যে আইনমন্ত্রী ২৮ সেপ্টেম্বর বলেছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তাঁর কাছে একটি আবেদন এসেছে, কিন্তু তিনি বলেন, ‘কবে এসেছে জানি না’ (একাত্তর টিভি অনলাইন, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব সংবাদের টাইমলাইন লক্ষ করলে দেখা যায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি বিষয়ে একধরনের ঔদাসীন্য প্রদর্শনকেই যথাযথ বলে বিবেচনা করছেন। তাঁরা সংবাদপত্র পাঠ করেন কি না, সেটা প্রশ্ন করার দরকার নেই, সরকার চাইলেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি প্রতিবেদন সংগ্রহ করতে পারত। সেটা দায়িত্বশীল ভূমিকা বলেই বিবেচিত হতো, মানবিকতার দিকটা নাহয় ঊহ্যই রাখলাম।
এখন গণমাধ্যমগুলো বলছে, সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক ইঙ্গিত আছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতিমধ্যেই জার্মান দূতাবাসের সঙ্গে যোগযোগ করেছেন। সরকারের অনুমোদন পাওয়া গেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিয়ে যেতে দূতাবাসের সহযোগিতা পাওয়া যাবে—এ নিশ্চয়তাও পাওয়া গেছে।
এ ধরনের কথাবার্তার অব্যবহিত আগে ২৫ সেপ্টেম্বর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, এ বিষয়ে সরকারের কিছু করার নেই। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১)-এর ধারার ক্ষমতাবলে শর্তযুক্তভাবে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায়।
এখন আইনের যে পরিস্থিতি, তাতে যদি কোনো পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে খালেদা জিয়াকে আগে যে শর্তযুক্ত মুক্তি, সেটি বাতিল করতে হবে। বাতিল করে স-অবস্থানে (আগের অবস্থায়) যাওয়ার পর আবার অন্য বিবেচনা করা যাবে। আইন অনুযায়ী, এখন যে অবস্থান, আইনের সেই অবস্থান থেকে সরকারের আর কিছু করার নেই’ (প্রথম আলো অনলাইন, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।
আইনমন্ত্রীর এ ধরনের যুক্তি যে আজই প্রথম দেওয়া হলো, তা নয়, ২০২১ সালেও এমন যুক্তি হাজির করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমার এক্সিকিউটিভ অথোরিটি দিয়ে তাকে বাসায় থাকার, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বাকিটা আইনগত ব্যাপার।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার, সেটুকু আমি দেখিয়েছি। আর কত চান, এখন সে অসুস্থ, এই আমি বললাম না, রাখে আল্লাহ মারে কে; মারে আল্লাহ রাখে কে। সেটিই মনে করে বসে থাকুন। এখানে আমার কিছু করার নেই।’ (ঢাকা পোস্ট, ১৭ নভেম্বর ২০২১)।
কিন্তু সেই সময়ে আইনজীবীরা এবং আইন বিষয়ে যাঁদের যৎকিঞ্চিৎ ধারণা আছে, তাঁদের সঙ্গে একমত হয়ে আমি উল্লেখ করেছিলাম, যে আইনের ধারার অধীন, অর্থাৎ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১)-এর ধারা অথবা ৪০১-এর ৬ উপধারা মোতাবেক বিশেষ আদেশের মাধ্যমে সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে (আলী রীয়াজ, ‘খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য ও বিএনপির ভবিষ্যৎ প্রশ্ন’, প্রথম আলো, ২১ নভেম্বর ২০২১)। এখনো আইনজীবীরা তা–ই বলছেন।
আইনজীবী শাহদীন মালিকের বক্তব্যটি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, নির্বাহী বিভাগের হাতে এই ক্ষমতা আছে এবং তার জন্য আদেশে যে সামান্য পরিবর্তন করার দরকার, তা ইতিমধ্যেই পাঁচবার করা হয়েছে, ষষ্ঠবার করার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই (দৈনিক যুগান্তর অনলাইন, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।
তিন দফা নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রী, যাঁর বয়স ৭৮ বছর এবং যিনি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে দুই বছরে বেশি সময় ধরে উপর্যুপরিভাবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁর সুচিকিৎসার বিষয় রাজনৈতিক কূটচালের বিষয় হতে পারে না, হলে তা সরকার বা রাষ্ট্রের মানবিকতার লক্ষণ নয়। খালেদা জিয়ার চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে এবং পর্দার আড়ালে যা ঘটছে বলে শোনা যাচ্ছে, সেগুলো আগামী নির্বাচনের ব্যাপারেই শুধু নয়, আগামী দিনের রাজনীতি বিষয়ে যা ইঙ্গিত দেয়, তা কোনো অর্থেই সুখকর নয়।
নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার এ বিষয় যে ক্ষমতাসীনেরা বোঝেন না, তা নয়; ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যই এ জন্য যথেষ্ট। তারপরও এখন এমনও বলা হচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী ৪ অক্টোবর দেশে না ফেরা পর্যন্ত এ বিষয়ে অগ্রগতির সম্ভাবনা কম। বিদেশে সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন, ফলে এই সিদ্ধান্তের জন্য তাঁর দেশে ফেরা অত্যাবশ্যকীয় নয়।
প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০২১ সালে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘কেউ জানে বেঁচে না থাকুক, সেটি আমাদের উদ্দেশ্য নয়’ (প্রথম আলো, ২৩ নভেম্বর ২০২১)।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে একধরনের ইতিবাচক ইঙ্গিত আছে, কিন্তু সরকার খালেদা জিয়া কোন কোন দেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন, সেটা উল্লেখ করবে বলে শর্তারোপের কথা শোনা যাচ্ছে এবং সেই তালিকায় চিকিৎসকেরা যে দেশগুলোর কথা বলেছেন, সেগুলো অনুপস্থিত। একজন রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে চিকিৎসকদের চেয়ে সরকারি কর্মকর্তারা কেন ভালো বুঝবেন, সেটা সাধারণ জ্ঞানে বোধগম্য নয়।
যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাঁকে ‘দেশে চিকিৎসা নিতে হবে’, তার বদলে ‘দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন’ বলাই যথেষ্ট। কিন্তু বিশেষ বিশেষ দেশে চিকিৎসা গ্রহণের শর্তারোপ করা হলে তা যে চিকিৎসার বিবেচনায় না করে রাজনীতির বিবেচনায় করা হবে, সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি সাধারণ মানুষের আছে।
আপনার মতামত জানানঃ