দেশের শিক্ষাকে ডিজিটালাইজড করার লক্ষ্যে সরকার আইসিটি শিক্ষা প্রকল্প শুরু করে। কিন্তু প্রকল্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও গাফিলতির কারণে প্রকল্পটি দাঁড়াতেই পারছে না। এদিকে আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (দ্বিতীয় পর্যায়ে) প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুস সবুর খানের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন স্বাক্ষরে সম্মানী বাবদ সাড়ে তিন মাসে প্রায় ১৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সরকারি তদন্তে দুর্নীতি ও প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত অভিযোগের প্রমাণ মেলার পরও নিজের চেয়ার দু’মাসেরও বেশি আঁকড়ে ছিলেন প্রকল্প পরিচালক। তবে শেষ রক্ষা হলো না। গতকাল মঙ্গলবার(০৫ জানু) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক আদেশে তাকে ওএসডি করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের এই কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার কথা জানানো হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব (কলেজ-২) ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ স্বাক্ষরিত আদেশে নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটির উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ জাকির হোসেনকে প্রকল্প পরিচালকের রুটিন দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পটিতে দীর্ঘদিন ধরেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছিল। সরকারি একাধিক তদন্তেও এসব অভিযোগের সত্যতা মেলে। এই প্রকল্পের কাজ ছিল মূলত দুটি। শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া স্থাপন। আর মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে ক্লাস পরিচালনার জন্য শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ। সরকার চেয়েছিল সারা দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ৩১ হাজার ৩৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ করবে। আর পৌনে ৬ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তাকে প্রযুক্তিনির্ভর ক্লাস পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেবে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির চোটে সব ভেস্তে গেছে। প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ, তবে দুর্নীতি হয়েছে দেদার। সেসবের তদন্তও হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্ত কর্মকর্তারা এতদিন স্বপদেই বহাল থেকেই কাজ করে আসছিলেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান ‘পরিদর্শন ও নীরিক্ষা অধিদফতরের’ (ডিআইএ) এক তদন্তে এ প্রকল্প পরিচালকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনাটি ধরা পড়ে। এ প্রকল্প পরিচালকের আত্মসাৎ করা ১৭ লাখ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করে গত বছরের অক্টোবর মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ডিআইএ। এখন পর্যন্ত আত্মসাৎ করা অর্থ ফেরতের নির্দেশ না দেওয়া হলেও মঙ্গলবার ড. মো. আব্দুস সবুর খানকে এ প্রকল্প থেকে সরিয়ে দিয়ে ওএসডি করলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ডিআইএ’র তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটি ছিল শিক্ষকদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়ার প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত। সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটি বাদ দিয়ে প্রশিক্ষণের সময়কাল ছিল মাত্র ৭৮ দিন। প্রশিক্ষণের ব্যাচ এক হাজার ১২১টি। প্রতি ব্যাচে প্রশিক্ষণার্থী ঠিক করা হয়েছিল ৩০ জন। প্রতিটি প্রশিক্ষণের স্থায়িত্বকাল ছিল ছয় দিন ও ১২ দিন। ভেন্যু সারাদেশে ২০টি। কিন্তু এই সময়সীমায়ও ওইসব প্রশিক্ষণে উপস্থিত ছিলেন এই প্রকল্প পরিচালক- এমন হাজিরা দেখিয়ে তিনি নিজের সম্মানী বাবদ গ্রহণ করেছেন ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ টাকা। যদিও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে তার ভিন্ন ভিন্ন স্বাক্ষর পাওয়া গেছে। সারাদেশের ২০টি ভেন্যুতে গত বছরের ৬ মার্চ থেকে ৩০ জুন অনুষ্ঠিত ওই প্রশিক্ষণে ৩৬টি জেলার ১০০ উপজেলার শিক্ষকরা অংশ নেন।
শুধু প্রশিক্ষণের সম্মানীই নয়, নিয়ম ভেঙে ভেন্যু ভাড়া প্রদান বাবদ সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে দেখানো হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। সেই টাকা নিয়মানুযায়ী ব্যাংকেও জমা করা হয়নি। প্রায় সব অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুনের কোনো তোয়াক্কাই করেননি প্রকল্পের পরিচালক। বিশেষ জরুরি প্রযোজনে বছরে তিনি ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ ছাড় করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও সেটাও মানেননি, ছাড় করেছেন কোটি কোটি টাকা। প্রশিক্ষণের জন্য মালপত্র কেনার ক্ষেত্রেও ছিল না কোনো দরপত্রের বালাই। নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান থেকেই কেনা হয়েছে কোটি কোটি টাকার প্রশিক্ষণসামগ্রী। এমনকি প্রশিক্ষণের জন্য যেসব মালপত্র কেনার কাগজপত্র দেখানো হয়েছে, তার সব পৌঁছায়নি প্রশিক্ষণস্থলে।
জানা গেছে, প্রকল্পের মেয়াদ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। মোট ১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ–সংক্রান্ত উপকরণ কেনার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৮৫৫ কোটি টাকা। আর প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৩১ কোটি টাকা। বাকি টাকা অন্যান্য আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয়ের জন্য ধরা হয়েছে।
মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ করার জন্য চার ধরনের উপকরণ কেনার কথা। এগুলো হলো ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর (স্কিনসহ), ইন্টারনেট মডেম ও স্পিকার। এই চারটি মিলে একটি সেট। মোট ৪৬ হাজার ৪৪৫ সেট উপকরণ কেনার কথা। কারণ, প্রকল্পে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে একাধিক সেট উপকরণ দেওয়ার প্রস্তাব আছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে এক সেট উপকরণও যায়নি। বিচ্ছিন্নভাবে ১৩ হাজার ৫৭৪টি ইন্টারনেট মডেম পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ল্যাপটপসহ অন্যান্য উপকরণ না দেওয়ায় এই মডেমগুলো ব্যবহারের সুযোগ নেই।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান প্রকল্প পরিচালকের যোগ দেওয়ার আগে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষের উপকরণ কেনাকাটার জন্য দরপত্রের কাজও শেষ হয়েছিল। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে উপকরণ কেনাকাটা বন্ধ করা হয়। এ নিয়ে একটি মামলাও চলমান। তখন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর বর্তমান প্রকল্প পরিচালক আবদুস সবুর খানের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন মূল কাজ কিছুই করতে পারেননি। হয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতি।
জানা যায়, শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য ম্যানুয়াল, সার্টিফিকেটসহ নানা সামগ্রী কেনাকাটায়ও ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া গেছে। নিয়মানুযায়ী সনদ ও ম্যানুয়াল বাবদ ব্যয় আলাদাভাবে দেখানোর কথা থাকলেও তা হয়নি। বিভিন্ন ভেন্যু থেকে পাওয়া ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩০ জনের প্রতিটি প্রশিক্ষণ কোর্সের ম্যানুয়াল বাবদ ৯ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ ব্যাগ বাবদ ৯ হাজার ৬০০ টাকা, প্রশিক্ষণসামগ্রী বাবদ এক হাজার ৮০০ টাকা এবং প্রতি ব্যাচের প্রশিক্ষণসামগ্রী পৌঁছানোর পরিবহন খরচ মোহাম্মদপুরের আনিশা এন্টারপ্রাইজকে পরিশোধ করা হয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ টাকার প্রশিক্ষণসামগ্রী সরবরাহ করার জন্য কীভাবে আনিশাকে নিযুক্ত করা হলো তার কোনো রেকর্ড নেই। অর্থাৎ কোনো দরপত্র ছাড়াই দুই কোটি ২৫ লাখ দুই হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কেনা মালপত্রের কোনো স্টক এন্ট্রিও করা হয়নি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণসামগ্রী ভেন্যু কর্তৃপক্ষ না পেলেও বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
এদিকে সরকারের নাকের ডগায় বসে আইসিটি প্রক্লপে একেরপর এক এমন হরিলুটে সরকারের উদাসিনতাকে দায়ি করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, সরকারের নজরদারির অভাবে প্রকল্পে এমন ধস নেমেছে। টাকা ফিরিয়ে দেওয়া আর ওএসডিতেই প্রকল্প লোপাটের শাস্তিকে সীমাবদ্ধ করার সমালোচনা করে তারা বলেন, করোনা ভাইরাস এমনিতেই সারাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস নামিয়েছে, সেখানে প্রকল্প পরিচালকদের এমন একেরপর এক অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতিতে দেশে শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। কেবল টাকা ফিরিয়ে দেওয়া আর ওএসডিতে নয়, প্রকল্পকে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য নতুন করে সাজানো এবং সেখানে কড়া নজরদারি রাখার আহ্বান জানান তারা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ