অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি খাতে সরকারের ঋণ বেড়েই চলছে। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে ঋণের টাকায়। অনেক সময় পরিচালন ব্যয় মেটাতেও ঋণ করতে হচ্ছে সরকারকে। যদিও জিডিপির তুলনায় সরকারের ঋণ এখনো বিপজ্জনক সীমায় যায়নি। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ঋণ-জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশ এখনো ভালো অবস্থানে আছে।
তবে কম রাজস্ব আয় ও ডলার সংকটের কারণে ঋণ পরিশোধ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ঋণের সুদ পরিশোধেই বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হচ্ছে। বর্তমানে দেশের মাথাপিছু ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার টাকারও বেশি।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৬ দশমিক ১৪ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণ মিলিয়ে চলতি বছরে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।
দেশের জনসংখ্যার বিবেচনায় নিলে মানুষের মাথাপিছু ঋণ দাঁড়ায় ৯৫ হাজার ১৯ কোটি টাকা। অবশ্য মাথাপিছু ঋণের তুলনায় আয় এখনো বেশি। দেশের মানুষের বর্তমান বাৎসরিক মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৯৩ ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ লাখ ৩ হাজার ৪০ টাকা।
অবশ্য আয় বেশি থাকলেও ঋণের ঝুঁকিই এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কম রাজস্ব আয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দেশের বাণিজ্য ঘাটতি সরকারের ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা কমিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ কখনই খেলাপি হয়নি।
তবে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণগ্রহণের পরিমাণ যে হারে বাড়ছে, তাতে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারপরও বর্তমানের সংকট কাটাতে সরকার আরও বেশি বিদেশি ঋণের দিকে ঝোঁক বাড়িয়েছে। এতে দেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ বাড়ছে গাণিতিক হারে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাত্র চার বছরের ব্যবধানে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। আর ২০১৬ সালের তুলনায় বর্তমানের এ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৭৯ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ১৯ টাকা। তবে, বর্তমানে আয় মাথাপিছু ঋণের চেয়ে বেশি।
দেশের জনগণের বর্তমান বার্ষিক মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৭৯৩ ডলার; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এ হিসাবে দেশের মাথাপিছু ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ১৯ টাকা। ২০১৯ সালে মানুষের মাথাপিছু ঋণ ছিল ৫৭ হাজার ৬১১ টাকা। অর্থাৎ চার বছরে ব্যবধানে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে ছিল ৩৪ হাজার ৫৩ টাকা। সে হিসাবে সাত বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ১৭৯ শতাংশ।
তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকার সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে সরকারের ঋণ কয়েকগুণ বেড়েছে। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ২৪২ শতাংশ আর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বেড়েছে ২৪২ শতাংশ। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য খাত থেকে ৭৫ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৮৯ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ঋণ ও জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ এখনও ভালো অবস্থানে। কিন্তু, ঋণের সুদ পরিশোধ করতে জাতীয় বাজেটের বড় একটি অংশ ব্যয় হয়।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আয় বেশি হলেও রাজস্ব সংগ্রহ কম হওয়ার কারণে ঋণের ঝুঁকি এখন মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং বাণিজ্য ঘাটতির কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যাহত হওয়ায় সরকারের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।’
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘ঋণ ও জিডিপির অনুপাত বিবেচনায় এটি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে, একটি সমস্যা হলো রাজস্ব আয়ে ধীরগতি এবং দেশের সর্বনিম্ন কর ও জিডিপির অনুপাত।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়গুলো হলো—বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, অলস ঋণের উচ্চহার, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার প্রবণতা।
সরকারের বিদেশি ঋণও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সরকারের বিদেশি ঋণ ছিল ৩ হাজার ৮৮৬ কোটি ডলার। পাঁচ বছর পর ২০২৩ সালের মার্চে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারে।
এদিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। আর ২০১৮-১৯ হিসাববছর শেষে এ ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ লাখ ৭৩ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, এ ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।
এসডব্লিউ/এসএস/২০২৫
আপনার মতামত জানানঃ