জাহাঙ্গীরের সময় আঁকানো ছবিগুলোতে এই মোগল সম্রাটের বিচিত্র স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। অনেকগুলোতে তার রাজনৈতিক স্বপ্নের প্রতিফলন দেখা গেছে। যেমন শাহ আব্বাসের সঙ্গে বসা ছবিটি পুরোপুরি কাল্পনিক। বাস্তবে দুই শাসকের কখনো মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি। শিল্প ইতিহাসবিদ ইবা কোচ বলেন, নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে এ ধরনের প্রতীকী চিত্রের মাধ্যমে বাদশারা কতটা মহান তা দেখানোর চেষ্টা করেছে।
রোবোটিক্স নিয়ে চলতি শতাব্দীতে উন্মাদনার কমতি নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি এই উন্মাদনাকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়। তবে বিষয়টি কেমন হয় যদি মধ্যযুগীয় ভারতের কোন শিল্পকর্মেই দেখা পান স্বয়ংক্রিয় এই যন্ত্রের ব্যবহার? ‘জাহাঙ্গীর এন্টারটেইনস শাহ আব্বাস’ নামের একটি চিত্রকর্মে ঠিক এমনটাই দেখতে পাওয়া যায়। যেটাকে দক্ষিণ এশীয় চিত্রকর্মে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের প্রথম দৃশ্যায়নও বলা হয়।
একজন সাধারণ দর্শকের কাছে ৪০০ বছর আগের রাজকীয় চিত্রে এই ‘রোবট’ খোঁজাকে বাড়াবাড়ি রকমের কৌতূহল মনে হতে পারে। তবে প্রকৃত সত্য হলো, চিত্রকর্মটি তখনকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রূপ, সেই সাম্রাজ্যের আত্মপরিচয় ও বিদেশী প্রযুক্তির পুনর্ব্যাখ্যা প্রকাশ করে।
মধ্যযুগে এমন চমকপ্রদ যান্ত্রিক বিষয়ের অস্তিত্ব থাকা অবশ্য অবাক করার মতো বিষয় নয়। যদিও সেগুলো এখনকার মানবাকৃতিক রোবটের মতো পরিশীলিত কিছু নয়। তবে ব্রোঞ্জ যুগেই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বা এমন কিছুর ধারণার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সংস্কৃত ভাষায় রচিত তখনকার কিছু গ্রন্থে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহিত্যিক ও প্রযুক্তিগত বর্ণনা পাওয়া যায়।
ভারতে প্রথম যান্ত্রিক খেলনার অস্তিত্বের তথ্য পাওয়া যায় ১৫৫৭ সালে। তখন ভারতে বাদশা আকবরের শাসন চলছিল। ‘আর্ট অন দ্য জেসুইট মিশনস ইন এশিয়া অ্যান্ড লাতিন আমেরিকা’য় শিল্প ইতিহাসবিদ গভিন বেইলি উল্লেখ করেন, লাহোরে বড়দিন উদযাপন প্রদর্শনের জন্য ভারতের গোয়া থেকে দুটি শিল্পকর্ম নিয়ে যান পুরোহিত জেরোনিমো জেভিয়ার। একটি হলো এমন বানর, যারা চোখ আর মুখ থেকে পানি বের হয়। আরেকটি হলো তার উপরে থাকা পাখি, যা গান গাইত।
১৬২০ সালে আঁকা ‘জাহাঙ্গীর এন্টারটেইনস শাহ আব্বাস’ চিত্রকর্মে দেখা যায় মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর পারস্যের (বর্তমান ইরান) সাফাভি বংশের রাজা শাহ আব্বাসের সঙ্গে কথা বলছেন। তাদের দুই পাশে আছে জাহাঙ্গীরের ভাই আসাফ খান ও পারস্যের নিয়োজিত মোগল রাষ্ট্রদূত খান আলম (ডানে)। তাদের চারপাশে আছে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আনা সাজসজ্জার সরঞ্জাম।
শ্যারন লিটলফিল্ড তার প্রবন্ধ ‘দ্য অবজেক্ট ইন দ্য গিফট: অ্যাম্বাসিস অব জাহাঙ্গীর অ্যান্ড শাহ আব্বাস’- এ উল্লেখ করেন, চিত্রটিতে আছে ভেনিসের একটি তৈজসপত্র, চীনের কাপ, একটি তরবারি, ইতালিয়ান টেবিল এবং পানীয় উপস্থাপন করার ইউরোপীয় জলযান (হরিণের উপর বসা ডায়ানা)।
আর এই শেষ বস্তুটি নিয়েই যত কৌতূহল। খান আলমের বাম হাতে থাকা হরিণের উপর বসা রোমান শিকারী দেবী ডায়ানার সোনালি ব্রোঞ্জের মূর্তিটি। যেটি হরিণের শিং আঁকড়ে ধরে আছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এখান থেকে পান করা যায় এমন কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না। এই অস্বাভাবিক জিনিসটা তাহলে ঠিক কী ছিল?
শিল্প ইতিহাসবিদরা গভীর পর্যবেক্ষণ শেষে জানিয়েছেন, এটি একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। যন্ত্রটি রোমান যুগে তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে চিত্রকর্মটি ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের ফ্রিয়ার গ্যালারিতে আছে। বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি এই গ্যালারির কিউরেটর ছিলেন জার্মান-আমেরিকান শিল্প ইতিহাসবিদ রিচার্ড এটিংহাউসেন। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত তার বই ‘পেইন্টিং অব দ্য সুলতান অ্যান্ড এমপেরোর অব ইন্ডিয়া ইন আমেরিকা কালেকশন’- এ প্রথম জাহাঙ্গীরের পেইন্টিংয়ে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, যান্ত্রিক খেলনাটি উদ্ভব হয়েছে ১৬ শতাব্দীতে জার্মানির অগসবার্গে। এতে চাকা আছে। আর হরিনের মাথাটি আলাদা করা যায়, যাতে ভেতরে মদ রাখা যায়।
ওয়াল্টার আর্ট মিউজিয়ামে এমন একটি যন্ত্র ছিল বলে উল্লেখ করেন গবেষক লরেঞ্জ সিলিগ। মিউজিয়ামের কিউরেটর জোয়ানাথ স্পাইসার বলেন, ডায়ানা যন্ত্রটির ব্যাস ৩০ ইঞ্চির মতো। মদ পানের জন্য একধরনের খেলায় তা ব্যবহার হতো। যন্ত্রটিতে বাতাস দেওয়া হতো আর তা গ্রামোফোনের মতো ঘুরতে থাকে এবং একসময় থেমে যায়। যে ব্যক্তির সামনে থামবে তাকে একবার মদে চুমুক দিতে হবে।
১৬ শতাব্দীতে তৈরীকৃত এই যন্ত্রের ১৬২০ সালে মোগল দরবারে আগমন প্রসঙ্গে জেসিকা কিটিং তার অ্যানিমেটিং এম্পায়ার: অটোমাটা, দ্য হোলি রোমান এম্পায়ার অ্যান্ড দ্য আর্লি মডার্ন ওয়ার্ল্ডে লেখেন, এমন স্বচালিত যন্ত্রের উদ্ভাবনের ওই সময়ে জনপ্রিয় ছিল অগসবার্গ। গিয়ার, চাকা আর স্প্রিং দিয়ে এসব যন্ত্র তৈরি হতো। ব্যবসায়ীক পণ্য এবং উপহার হিসেবে এগুলোর কদর ছিল। তাই রাজা থেকে রাজাদের মধ্যে তা উপহার হিসেবে দেওয়া হতে পারে।
জাহাঙ্গীরের দরবারে ডায়ানা কীভাবে আসল এবং চিত্রকর্মে তার উপস্থিতি কী তাৎপর্য রাখে তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিটিং। সম্ভবত অগসবার্গের অভিজাত কোনো বণিক পরিবার, বিশেষ করে ফুগারদের মাধ্যমে তা আসতে পারে ভারতবর্ষে। কারণ সেই ভারতবর্ষে আসা পর্তুগিজদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল পরিবারটি। ১৫ শতকের শেষ দিকে গোয়া ভারতের একটি ব্যস্ত নৌবন্দর হয়ে ওঠে। জার্মান ব্যবসায়ীদের এজেন্টরা তখন ইউরোপীয় পণ্য নিয়ে ভারতে আসত।
জার্মান কোম্পানি পর্তুগিজ সরকারের সাথে ব্যবসা বন্ধ করার পর, ১৫৯১ সালে ফুগারদের এজেন্ট ফার্দিনান্দ ক্রন গোয়াতে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করেন। তিনি মোগল দরবারের সাথে জড়িত বণিকদের সাথে সরাসরি ব্যবসা করতেন।
যেমন জানা যায়, রত্ন ব্যবসায়ী ডি কউটর ১৬১৯ সালে জাহাঙ্গীরকে ‘অগসবার্গের স্বচালিত নৌযান স্যুভেনির হিসেবে দিয়েছিলেন’। এই তথ্যের মাধ্যমেই অগসবার্গ এবং আগ্রার মধ্যকার যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়।
বিলেত থেকে মোগল দরবারে আসা এমন আরো যন্ত্রের কথাই জানা যায় ইতিহাস থেকে। মোগল সম্রাট আকবরের দরবারের সদস্য আবদ আল কাদেরের কাছে ১৫৭০ সালে সংগীতের যন্ত্র-অর্গান থাকার কথা জানা যায়। এ ছাড়া ১৬১৬ সালে জাহাঙ্গীরের দরবারে ইংল্যান্ড থেকে আসে একটি ঘড়ি। এগুলোর বেশিরভাগই পারস্য থেকে আসত।
ইতিহাসবিদ আয় কায়সার তার এক বইতে উল্লেখ করেন, পারস্যের বাদশা শাহ আব্বাস জাহাঙ্গীরকে ‘ফাইভ ক্লথ’ উপহার দেন। আর এ কারণে ধারণা করা হয় যে, যান্ত্রিক খেলনাটি হয়তো শাহ আব্বাসের উপহার হিসেবেই এসেছিল। গবেষক কিটিংও এই সম্ভাবনার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
কিটিং লেখেন, সুসম্পর্ক বজায় রাখতে এখনকার মতো সে সময়েও উপহার লেনদেন হতো। তখনকার দূতাবাসগুলোর কাজের অন্যতম অংশই ছিল এসব উপহার পাঠানো ও গ্রহণ করে পৌঁছে দেওয়া।
এই সম্ভাবনার একটি বাস্তব যুক্তি চিত্রকর্মেই পাওয়া যায়। খান আলমের দস্তানাযুক্ত ডান হাতে একটি বাজপাখি দেখা যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর তার স্মৃতিকথায় উপহার হিসেবে বাজপাখি পাওয়ার কথা উল্লেখ করেন। তাই অনুমান করা হচ্ছে খান আলমের বাম হাতের বস্তুটিও (হরিণে বসা ডায়ানা) উপহার।
মজার ব্যাপার হলো এখনো উপসংহারে আসার সুযোগ নেই। কারণ জাহাঙ্গীরের দরবারের ইংরেজ কূটনীতিক থমাস রো ১৬১৬ সালের এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ রাজা জেমস স্টুয়ার্ট কর্তৃক বাদশাকে দেওয়া উপহারের তালিকায় ‘ডায়ানা’ শব্দের উল্লেখ করেছিলেন।
জাহাঙ্গীরের সময় আঁকানো ছবিগুলোতেই এই মোগল সম্রাটের বিচিত্র স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। অনেকগুলোতে তার রাজনৈতিক স্বপ্নের প্রতিফলন দেখা গেছে। যেমন শাহ আব্বাসের সঙ্গে বসা ছবিটি পুরোপুরি কাল্পনিক। বাস্তবে দুই শাসকের কখনো মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি।
শিল্প ইতিহাসবিদ ইবা কোচ বলেন, নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে এ ধরনের প্রতীকী চিত্রের মাধ্যমে বাদশারা কতটা মহান তা দেখানোর চেষ্টা করেছে। তাই চিত্রের ডায়ানার উপস্থিতি বুঝতে তা আঁকানোর প্রেক্ষাপটে নজর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
১৬০৫ সালে, আঞ্চলিক সংঘর্ষের পটভূমিতে সাফাভিদ সৈন্যদের দ্বারা কান্দাহারের মোগলদের সীমান্ত দুর্গ অবরোধের প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে পারস্য ও হিন্দুস্তানি সাম্রাজ্যের মধ্যে সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দুই সাম্রাজ্যে দূতাবাস স্থাপন হয়। ১৬১১ সালে পারস্যের দূত ইয়াদগার আলী আসেন আগ্রায়। আর ১৬১৩ সালে খান আলম পারস্য যান এক হাজর মোঘল দরবারী নিয়ে। তাদের মধ্যেই ছিলেন শিল্পী বিষাণ দাস। যিনি চিত্রকর্মটি আঁকান। তাহলে এখনো দুজনের বসে থাকা এবং সেখানে ডায়ানার উপস্থিতির তাৎপর্য কী? এর উত্তর হয়তো কিছুট পাওয়া যাবে আরেকটি চিত্রকর্মে।
১৬১৮ সালে শিল্পী আবুল হাসান আঁকেন জাহাঙ্গীর অ্যাম্ব্রেসেস শাহ আব্বাস। চিত্রের সিংহের উপর দাঁড়িয়ে আছেন জাহাঙ্গীর। আর কালো ও বেঁটে শাহ আব্বাস দাঁড়িয়ে আছেন মেষের ওপর। প্রাণীদের নিচে বিশ্বের মানচিত্র। যেখানে সিংহটি শুয়ে আছে পুরো মধ্য এশিয়াজুড়ে। শিল্প ইতিহাসবিদরা বলেন, এখানে জাহাঙ্গীরের বীরত্বপূর্ণ উপস্থিতি দেখানো হয়েছে। এই ছবিতে পশ্চিমা মানচিত্রের মতো ‘জাহাঙ্গীর এন্টারটেইনস শাহ আব্বাসে’ও ডায়ানার মাধ্যমে একই রকম আভিজাত্য ও গৌরব দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। আর তখনকার রাজত্বে আন্তর্জাতিক প্রভাবের বিষয়টিও এর মাধ্যমে বোঝা যায়।
দক্ষিণ এশিয়ায় এমন যান্ত্রিক খেলনা দ্বিতীয়টি ছিল টাইগার অব টিপু সুলতান। ১৭৯৫ সালে বানানো এই যন্ত্রে দেখানো হয়, একজন বিদেশি সেনাকে আক্রমণ করছে বাঘ। সূত্র: টিবিএস নিউজ।
এসডব্লিউএসএস১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ