২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ার হামলার পর থেকে বিশ্বে জোরালো হয়েছে ইসলাম-ফোবিয়া। মার্কিন মুলুকে মুসলমান হওয়া মানেই যেন এখন ‘পশ্চাৎপদ’, ‘রক্ষণশীল’, ‘চরমপন্থি’ কিংবা ‘নারী-স্বাধীনতার বিরোধী’। আর এখন এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। সেবারের নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রচারণার অস্ত্র করেছিলেন ইসলামকে। ছড়িয়েছিলেন মুসলমানবিরোধী নানা অপপ্রচার। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মুসলিমবিরোধী ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তিনি। তার শাসনে মুসলমান পরিচয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারীদের ধারাবাহিক বঞ্চনা জোরালো হয়েছে। এর ছাপ এখনও সর্বত্র। কেউ ক্ষমতা ধরে রাখতে, কেউ অস্ত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে, কেউবা প্রগতিশীলতা রুখে দিতে ইসলাম-ফোবিয়াকে জিইয়ে রাখতে চাইছে। আর এই চেষ্টার প্রদীপে ঘি ঢালছে খোদ ইসলামী বিশেষজ্ঞরাই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা ও ঘৃণার মতাদর্শ প্রচার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এসব জায়গায় উদার অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আদর্শবহ মতামত ও ব্যক্তিকে আঘাত করা হচ্ছে। পাশাপাশি নারীরা এই আক্রমণের বিশেষ শিকার হচ্ছে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইসলাম। রীতিমত অশ্রাব্য ভাষায় গালি-গালাজ আর তিরস্কার চলে! এর ফলে সাধারন মানুষদের মধ্যে ইসলাম বিতর্কিত হচ্ছে। এসব অযথা বিতর্ক মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের পরিবর্তে ঘৃণা ও অবিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর এখন এটা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বহির্বিশ্বেও। এর ফলাফল হচ্ছে ভয়াবহ, বাড়ছে ইসলামফোবিয়া, বাড়ছে ঘৃণা। আর এ প্রসঙ্গেই এবার আলোচনায় ইসলামী বক্তা ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী।
দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী, জাকির নায়েক, মিজানুর রহমান আজহারীর পর শোনা যাচ্ছে এবার লন্ডনে নিষিদ্ধ হতে পারেন এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী। তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমরের পক্ষে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর বক্তব্য তুলে ধরে আব্বাসীকে ব্রিটেনে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার জন্য হোম অফিসের কঠোর সমালোচনা করেছেন এক ইউকিপ ও বেক্সিট নেতা নাইজেল ফারাজ।
বর্তমানে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল আই অন টিভির আমন্ত্রণে ইসলামী কনফারেন্সে যোগ দিতে বর্তমানে লন্ডনে অবস্থা করছেন ইসলামী বক্তা ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী। আব্বাসীর এ লন্ডন সফর নিয়ে হঠাৎ করেই যেন ব্রিটেনের একটি মূলধারার গণমাধ্যমে তাকে নিষিদ্ধ করার দাবি উত্থাপিত হচ্ছে।
আজ ২২ জুন বৃহস্পতিবার লন্ডনের রয়েল রিজেন্সি হলে ঘোষিত ইসলামিক বক্তা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী অনুষ্ঠানটি নিউহ্যাম কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ বাতিল করে দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে আই অন টিভি তাদের এক বিশেষ ঘোষণায় জানিয়েছে নিরাপত্তা জনিত কারণে অনুষ্ঠানটি স্থগিত করা হয়েছে।
জিবি নিউজ নামের টেলিভিশন চ্যানেলে সাবেক ইউকিপ নেতা ও ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের বহুল আলোচিত নাম নাইজেল ফারাজ তার অনুষ্ঠানে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। তিনি অনুষ্ঠানে তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমরের পক্ষে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর বক্তব্য তুলে ধরে আব্বাসীকে ব্রিটেনে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার জন্য হোম অফিসের কঠোর সমালোচনা করেন।
নানাভাবে বিতর্কিত আব্বাসী
দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে উগ্রবাদী বক্তব্যের জন্য আলোচিত ও সমালোচিত ছিলেন ইসলামিক বক্তা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী। দেশের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার, জায়গা- জমি দখল করতে উস্কানি, নাস্তিক ব্লগারদের হত্যা, জঙ্গিবাদে উৎসাহিত করা, কাদিয়ানীদের হত্যা করতে উস্কানি দেয়াসহ তার এমন বিভিন্ন বক্তব্য বিভিন্ন সময় ভাইরাল হলেও বিশেষ কোন রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় তার বিরুদ্ধে দেশে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।
এর পূর্বে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটুক্তি, ইতিহাস বিকৃতি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জঙ্গি বলে আখ্যায়িত করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ১৮ মে শাহবাগ থানায় মামলা হলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। একই বছরে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে গণকমিশনে প্রকাশিত ২ খণ্ডের শ্বেতপত্রে এনায়েত উল্লাহ আব্বাসীকে প্রথম সারির উগ্রবাদী বক্তব্য হিসেবে তার সেসব বক্তব্যসহ অভিযুক্ত করা হলেও তিনি পার পেয়ে যান।
তবে ব্রিটেনে গিয়ে তার রক্ষা হয়নি। বাংলাদেশ সরকার ব্যবস্থা না নিলেও ব্রিটেনের সরকার ঠিকই ব্যবস্থা নিয়েছে এবং তার প্রোগ্রাম বাতিল করেছে। তার বিরুদ্ধে আরও পদক্ষেপ চলমান আছে বলে জানা গিয়েছে।
গত ১০ জুন ব্রিটেনে অবস্থানরত এক বাংলাদেশি প্রবাসী দ্বারা পরিচালিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যানেল ION টিভির আমন্ত্রণে ইসলামী কনফারেন্সে যোগ দিতে তিনি ব্রিটেন যান। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশি নির্বাসিত ব্লগার ও মানবাধিকারকর্মী আসাদ নূর এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর উগ্রবাদী কিছু বক্তব্যকে ইংলিশে অনুবাদ করে ইংলিশে একটি ভিডিও বানিয়ে ১৯ জুন রাতে তার ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে পাবলিশড করেন।
বাংলাদেশি ব্লগার আসাদ নুর’র সেই ভিডিও ব্লগটি
এই ভিডিও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে তা বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা এবং ব্রিটেনের মিডিয়ার দৃষ্টিগোচর হয়। মানবাধিকার সংস্থা তার তার উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড উল্লেখ করে বিবৃতি দেন এবং যুক্তরাজ্যের একটি মূলধারার গণমাধ্যম GB News সহ আরও কিছু বিদেশি নিউজ তার বিরুদ্ধে এবং তাকে যারা আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে খবর প্রচার করে। এছাড়াও বাংলাদেশি কিছু অনলাইন একটিভিস্ট তার বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে তার গতকালের একটি প্রোগ্রাম এবং আজকের মূল প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়। গতকাল রাতে নিউহামের নিরাপত্তা বিষয়ক কেবিনেটের সদস্য কাউন্সিলর এমার ভার্দি বাংলাদেশি এক অনলাইন একটিভিস্টকে ইমেইলের মাধ্যমে এই তথ্য নিশ্চিত করেন এবং এরপরই GB News আজ অফিশিয়ালি তার প্রোগাম বাতিলের খবর প্রচার করে। এছাড়াও, তার বিরুদ্ধে যেন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং নিষিদ্ধ করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয় সে বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে আব্বাসী
যুক্তরাজ্যের মূলধারা গণমাধ্যম জিবি নিউজ নামক টেলিভিশন চ্যানেলে সাবেক ইউকিপ নেতা ও ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের বহুল আলোচিত নাম নাইজেল ফারাজ তার অনুষ্ঠানে বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। সেখানে তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমরের পক্ষে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর বক্তব্য তুলে ধরে আব্বাসীকে ব্রিটেনে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার জন্য হোম অফিসের কঠোর সমালোচনা করেন। চার্লি পিটার নামের যে সাংবাদিক এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তৈরি করেন, তাকেও সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
চার্লি বলেন, তারা আয়োজক টেলিভিশন চ্যানেল আই ওন টিভি ও বার্মিংহামের হলের মালিকের সাথে যোগাযোগ করেছেন। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ও হল কর্তৃপক্ষ দুজনই জিভি টিভিকে জানিয়েছে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর ঘৃণা ছড়ানো ওয়াজ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নাই। এ বিষয়ে তারা অবগত নন।
সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, বিগত দিনে জাকির নায়েক, মিজানুর রহমান আজহারীকে যুক্তরাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর মত বক্তা প্রবেশ করার সুযোগ পায় কীভাবে? জিবি নিউজে এই প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়াতে বাঙালি কমিউনিটিতেও আলোচনা শুরু হয়েছে। গত ২০ জুন বার্মিংহামে প্রথম অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়েই জিবি নিউজের অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়৷ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী একজন জানান, সন্ধ্যা ৬টার পরিবর্তে রাত ৯টায় আব্বাসী অনুষ্ঠান স্থলে আসেন। এবং এর আগে মিডল্যান্ড পুলিশের একটি দল সেখানে গিয়ে অনেকের সাথে কথা বলে, ফলে অনেক দর্শক অনুষ্ঠান স্থান ত্যাগ করেন বলে জানা গেছে।
ভারতীয় একটি পোর্টালে ও এ নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে, সেখানে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশী ইসলামপন্থী আলেম, যিনি আহমদিয়াদের হত্যা করতে চান, হিন্দুদের জমি দখল করতে চান, ভারত আক্রমণ করতে চান, এখন যুক্তরাজ্যে উগ্রবাদ ছড়াচ্ছে শিরোনামে সেই লেখায় এনায়েতুল্লাহ’র নানা বিতর্কিত বক্তব্যের ভিডিওসহ প্রচার করা হয়েছে।
আজ ২২ জুন বৃহস্পতিবার লন্ডনের রয়েল রিজেন্সি হলে ঘোষিত অনুষ্ঠানটি নিউহ্যাম কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ বাতিল করে দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে আই অন টিভি তাদের এক বিশেষ ঘোষণায় জানিয়েছে নিরাপত্তা জনিত কারণে অনুষ্ঠানটি স্থগিত করা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে সিবিএন বলছে, আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিশ্বাস করি। আমরা বিভিন্ন সংস্কৃতিকে জানতে চাই। অংশগ্রহণ করতে চাই নানা বিতর্কে। কিন্তু মত প্রকাশের অধিকারেরও সীমাবদ্ধতা আছে। মত প্রকাশের অধিকারের নামে কেউ ঘৃণা ছড়াতে পারে না, কেউ দাঙ্গা উস্কে দিতে পারেনা। আমরা কখনই এই ধরনের মত প্রকাশের অধিকারকে সমর্থন করিনি। করবো না।
এসডব্লিউএসএস১৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ