![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2022/01/a465ecfc3b5f8bbc0f8b05839a1fd529-61e31b31d5fc7.webp)
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের ভোটের প্রাথমিক ফল ঘোষণার পর পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা না পাওয়া নিয়ে নানা ধরণের বিতর্ক শুরু হয়েছে।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মধ্যে অনেকে বলছেন যে, এই ক্ষমতা না পেলেও কমিশনের সার্বিক ক্ষমতা কমবে না। আবার নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলছেন যে, নির্বাচন কমিশন মন্ত্রীসভার কাছে এই ক্ষমতা চেয়েই আসলে তাদের ক্ষমতা কমিয়ে নিয়েছে।
বৃহস্পতিবার মন্ত্রীসভায় ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনী প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। গত বছর এই সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।
এই সংশোধনী প্রস্তাবে নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের একটি বিধান স্পষ্ট করার জন্য নতুন আরেকটি উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব করেছিল।
যেখানে বলা হয়েছিল, নির্বাচনের প্রাথমিক ফল ঘোষণার পর তা গেজেট আকারে প্রকাশের আগে অনিয়ম বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ পেলে কোন ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের নির্বাচনের ফল স্থগিত করতে পারবে। পরে এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে পুরো আসনের ভোট বাতিল করে আবারো নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।
তবে মন্ত্রীসভা পুরো আসনের নির্বাচন বাতিলের এই ক্ষমতা ইসিকে দেয়নি। এই সময়ের মধ্যে পুরো আসনের না হলেও অনিয়মের অভিযোগ থাকলে সেই সংখ্যক ভোট কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিলের মতো আংশিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
গত বছরের ১২ই অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।
সেসময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, “আমরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি যে ভোটগ্রহণে অনিয়ম হচ্ছে। অনেক কেন্দ্রেই আমরা গোপনকক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করেছি।”
গাইবান্ধার ওই আসনের উপ-নির্বাচনের ভোট গ্রহণ বন্ধ করে সরকারি দলীয় নেতাদের বেশ সমালোচনার মুখেই পড়েছিল নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, গাইবান্ধার মতো নির্বাচন চলাকালীন সময়ে সেটি বাতিল করার ক্ষমতা এখনো নির্বাচন কমিশনের রয়েছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনেই দেয়া আছে।
উনিশশো বাহাত্তর সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৭ম অধ্যায়ের ৯১(ক) ধারায় বলা হয়েছে যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি-প্রদর্শন ও চাপ সৃষ্টিসহ বিবিভন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে, নির্বাচন কমিশন যে কোনো ভোট কেন্দ্র বা (ক্ষেত্রমতে সম্পূর্ণ নির্বাচনি এলাকায়) নির্বাচনের যেকোন পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনি কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনের এর আগের যে ক্ষমতা ছিল সেটি নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। বরং তারা যে নতুন বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল তার মধ্যে একটি নিয়ে অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে।
আর এটি হচ্ছে, নির্বাচনের সময় রিটার্নিং অফিসার যখন প্রাথমিকভাবে ফল ঘোষণা করে, তারপর সেটি যাচাই করে চূড়ান্ত ফল উল্লেখ করে গেজেট প্রকাশ করে। নির্বাচন কমিশন চেয়েছিল যে, এই মধ্যবর্তী সময়টাতে যদি কোন ফলাফল নিয়ে কোন অভিযোগ আসে এবং সেটি তদন্ত করার পর যদি সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে আংশিক বা পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা চেয়েছিল। তবে সরকার পুরোটাতে রাজি হয়নি।
তিনি বলেন, সরকার বলছে যে, তদন্তের পর যতগুলো কেন্দ্রে অনিয়ম হওয়ার সত্যতা পাওয়া যাবে, সেই কেন্দ্রগুলোর ভোট বাতিল করা যাবে।
“এমনকি মেজরিটি কেন্দ্রে অনিয়ম পাওয়া গেলেও সেগুলোর সবই বাতিল হবে। সেখানে রিপোলিং হবে। কিন্তু পুরো নির্বাচন বাতিল হবে না।”
নির্বাচন কমিশন নতুন যে প্রস্তাব করেছিল তার দরকার আছে বলেও মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, এর প্রয়োজনীয়তা তিনি নিজে কমিশনার থাকা অবস্থায়ও অনুভব করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালের পর মোহাম্মদ আবু হেনা প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকার সময়ে টাঙ্গাইল-৮ আসনের উপনির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনের ফল প্রকাশের গেজেট স্থগিত করে রাখা হয়েছিল। আইনি জটিলতার কারণে এটি প্রায় চার বছর আটকে ছিল।
“ক্লিয়ার কাট আইন না থাকার কারণে আপনি যদি এটা অন্য প্রভিশনে আগাতেন তাহলে কোর্টে যেতো।”
নির্বাচন কমিশন যে ক্ষমতা চেয়েছিল তা দিলে কোন সমস্যা হতো বলে মনে করেন না সাখাওয়াত হোসেন। তবে আস্থাহীনতা থেকেই সরকার এটি দিতে চায়নি বলেও মনে করেন তিনি।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “এটা মিসট্রাস্ট, টোটাল মিসট্রাস্ট। ইলেকশন কমিশনকে এতোখানি ক্ষমতা দিয়ে কতোখানি ট্রাস্ট করতে পারবে সেটা হলো কথা আরকি।”
তবে এই আইন ছাড়াও নির্বাচন কমিশন এখনো নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা রাখে বলেও মনে করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, সংবিধানে বলা আছে যে, নির্বাচন কমিশন যাতে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে। সেটা করতে না পারলে যে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতাও কমিশনের রয়েছে। আর এ বিষয়ে একাধিক রায়ও রয়েছে বলে জানান তিনি।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক মুনিরা খান বলেন, অভিযোগ থাকার পরও কোন নির্বাচন বাতিল করা হবে কিনা তা বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন কতটা আসন, কত, ভোট, কত ভোটার এবং যেখানে ভোট বাতিল করা হবে তা বন্ধ করলে মূল নির্বাচনী এলাকার উপর কতটা প্রভাব ফেলে ইত্যাদি।
যদি এমন হয় যে, চারটা জায়গায় ভোট বন্ধ করা হলেও ওই জায়গায় যত ভোট ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান যদি তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সেই ভোট বন্ধ করা না করা সমান। কিন্তু ব্যবধান যদি কম হয়, তাহলে অনিয়মন হলে তখন বন্ধ করাটা গুরুত্বপূর্ণ।
মুনিরা খান মনে করেন, যেহেতু সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের তাই তাদের হাতে সব ধরণের ক্ষমতা দেয়া উচিত।
তবে নির্বাচন বাতিলের বিষয়ে আরো পরামর্শের দরকার আছে বলেও মনে করেন তিনি। তার মতে, যদি দু’চারটি জায়গায় গণ্ডগোলের কারণে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করার ধারণা প্রচলিত হলে, অসদ প্রার্থীরা এর সুযোগ নিতে পারে। এছাড়া, নির্বাচন বাতিল করে সেখানে পুর্নির্বাচন করায় ব্যয়েরও একটি বিষয় আছে বলে মনে করেন তিনি।
স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গেজেট ঘোষণার আগে নির্বাচন বাতিল বিষয়ে যে আংশিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেটির সুবিধা-অসুবিধা নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের উপর।
তবে মন্ত্রীসভা যেই প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে তা উচ্চ আদালতের রায়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
উচ্চ আদালতের আপীল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় অনিয়ম, কারচুপি হলে বা নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে নির্বাচন কমিশন সত্যতা নিরূপন করে নির্বাচন বাতিল করতে পারবে এবং পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারবে।
“এখানে কোন সেন্টার বা কেন্দ্রের বিষয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। তাো যেখানে প্রয়োজন মনে করবে সেখানেই সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।”
এছাড়া সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন আইনের বিধিবিধানও সংযোজন করতে পারে বলে উচ্চ আদালতের রায় আছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি তাদের সব রকম ক্ষমতা আছে মন্ত্রীসভার এই প্রস্তাব সত্ত্বেও কারণ উচ্চ আদালতের রায় আইনের সমতুল্য এবং সবার এটা মানা বাধ্যতামূলক।”
বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, মন্ত্রীসভায় তারা যে প্রস্তাব করেছে তা সঙ্গত হয়নি। কারণ তাদের এই ক্ষমতা ইতিমধ্যেই আছে।
তিনি বলেন, “ক্ষমতা চেয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমতা খর্ব করার প্রচেষ্টা হতে পারে, ঠিক তাই হয়েছে।”
এখন নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবে কিনা, তাদের ক্ষমতা তারা প্রয়োগ করতে পারবে কিনা তা নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের উপর।
এসডব্লিউএসএস/২১১৫
আপনার মতামত জানানঃ
![Donate](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/06/xcard.jpg.pagespeed.ic.qcUrAxHADa.jpg)
আপনার মতামত জানানঃ