পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির রামগড়ে ফেনী নদীর ওপর নির্মিতব্য বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ এর নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্ন। রামগড়ের মহামুনি এলাকায় প্রায় ২শ’ ৮৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় তিন বছর আগে। এটি রামগড় উপজেলা ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম মহকুমার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে।
সেতুটির নির্মাণ কাজ আগামী ৫ জানুয়ারির মধ্যে শেষ হবে। চলতি মাসেই এই সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে পাহাড়িদের মধ্যে এ নিয়ে দেখা যাচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একদিকে তারা আশা করছেন এই সেতুর মাধ্যমে উন্নতি ও দুর্ভোগ মোচনের। অন্যদিকে সেতুকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধিসহ নানামুখী বিপদের শঙ্কাও রয়েছে তাদের।
জানা গেছে, সেতুটি তৈরি করা হচ্ছে মূলত ভারতের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে পণ্য রফতানিকে কেন্দ্র করেই। ১২টি পিলার সম্বলিত সেতুটির বাংলাদেশ অংশে নির্মাণ করা হয়েছে আটটি এবং ভারতের অংশে চারটি পিলার। এছাড়া স্প্যান রয়েছে ১১টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে সাতটি ও ভারত অংশে চারটি। সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পরপরই রামগড়ে একটি স্থলবন্দরের নির্মাণ কাজ শুরু হবে। ইতিমধ্যে স্থলবন্দরের জন্য প্রায় ১০ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
ভারত সরকার দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে তাদের সেভেন সিস্টারখ্যাত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের গেটওয়ে হিসেবে দেখছে রামগড় স্থলবন্দরকে। ভারতের ন্যাশনাল হাইওয়েস অ্যান্ড ইনফ্রাস্টাকচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড (এনএইচআইডিসিএল) এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তানিশ চন্দ্র আগারভাগ ইনপাকন প্রাইভেট লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে ৮২ দশমিক ৫৭ কোটি রুপি ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণ করছে।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরকালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর চালুর যৌথ সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বাংলাদেশ-ভারত দু’দেশের মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা, যাতায়াত ব্যবস্থা সহজতর করা এবং আমদানি-রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ নামে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির ভিত্তি প্রস্থর ফলক উন্মোচন করেন। ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে মৈত্রী সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, স্থলবন্দর নির্মিত হলে গতিশীল হবে পাহাড়ের অর্থনীতি। দু’দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, কর্মসংস্থান, আমদানি-রফতানিসহ অর্থনীতর নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে এমনটাই মনে করছে স্থানীয়রা। এটি হবে দেশের ১৫তম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম স্থলবন্দর। বাংলাদেশ সরকারের তরফে এই সেতু সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। রামগড়-বারৈয়ারহাট সড়কের বেশ কয়েকটি দু’লেন বিশিষ্ট সেতু নির্মাণাধীন রয়েছে। ৮ আগস্ট ২০২০ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে হেয়াকো-বারৈয়াইয়ারহাট সড়কের জন্য ৮৪৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্পসহ সাতটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাঈদ মোমেন মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেতুকে কেন্দ্র করে রামগড়-হেঁয়াকো-বারৈয়ারহাট প্রধান সড়ক প্রশস্তকরণ সংক্রান্ত প্রকল্প, লোড কন্ট্রোল স্টেশন সংক্রান্ত প্রকল্প এবং স্থলবন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্পের মধ্যে দুইটি সড়ক ও জনপদ বিভাগের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। স্থলবন্দর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ পর্যায়ে। স্থলবন্দর নির্মিত হলে গতিশীল হবে পাহাড়ের অর্থনীতি। ’
তবে এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে পাহাড়িদের মধ্যে রয়েছে সন্দেহ ও আতঙ্ক। এই সেতু ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় পাহাড়ের বিবদমান গ্রুপগুলোর সক্রিয়তাও বাড়তে পারে। চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ নানা বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন স্থানীয়রা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাকমা জাতিগোষ্ঠীর স্থানীয় একজন স্কুল শিক্ষক বলেন, সেতু ও বাকি কাজগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর এই এলাকায় বাইরের লোকের আনাগোনা আরো বাড়বে। সেতু ও বন্দর হলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি হুমকির সম্মুখীন হতে পারে বলে জানান তিনি।
তবে সেখানে বসবাসরত বাঙালি অধিবাসীরা বিষয়টিকে ভিন্ন চোখে দেখছেন। সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে দু’দেশের সীমান্তবাসীরা আগের চেয়ে ভাল থাকবে। তাদের আশা, দ্রুত স্থলবন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ হলে বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ কর্মসংস্থান। তবে সেতুকে কেন্দ্র করে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় অংশেই অপরাধ তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার ভয় বাঙালিরাও নাকচ করছেন না।
এসডাব্লিউ/এসএন/আরা/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ