মানব সভ্যতার বিকাশ ও ইতিহাস সম্পর্কে আমরা একটি কাঠামোগত ধারণা লাভ করলেও অনেক সত্য রয়ে গেছে অজানা। কালের বিবর্তনে অনেক ঘটনাই হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতা থেকে। সেই হারিয়ে যাওয়া সত্যকে জানার তাগিদ থেকে, আবার অনেক সময় কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে বা দুর্ঘটনাবশতই পৃথিবীর নানাপ্রান্তের মানুষ আবিষ্কার করেছে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন সব তথ্য জানতে সাহায্য করেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের আবিষ্কার সবসময় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের পূর্বপুরুষদের সৃজনীশক্তির কথা। আর এই আবিষ্কারগুলোর বদৌলতে আমাদেরও সুযোগ হয় শতবর্ষ পুরনো সেই নিদর্শনগুলোর ব্যাপারে জ্ঞান অর্জনের। শতবর্ষী এই নিদর্শনগুলোকে ঘিরে থাকা রহস্যের সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়। এমনই ৫টি রহস্যে ঘেরা নিদর্শন নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
টেরাকোটা সৈন্যদল
১৯৭৪ সালে চীনের জিয়ানে (Xian) একদল প্রত্নতাত্ত্বিক একটি খননকাজ পরিচালনা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অন্ত্যেষ্টিক্রমা, টেরাকোটার সৈন্যদল আবিষ্কার করে। সম্রাট কিন শি হুয়াং (Qin Shi Huang) এর সমাধির নিচে হাজার হাজার পোড়ামাটির তৈরি সৈন্যদল পাওয়া যায়। সম্রাটের সমাধিতে পোড়ামাটির সৈন্যদের দেয়ার কারণ ছিল মৃত্যুর পর সম্রাটকে বিভিন্ন অপশক্তির হাত থেকে সুরক্ষা প্রদান করা। প্রাচীন এই নিদর্শনের বয়স প্রায় ২০০০ বছর।
পোড়ামাটির মূর্তিগুলোর পাশাপাশি সমাধির ভেতর বেশ কিছু অস্ত্র পাওয়া গেছে এবং অস্ত্রগুলো খুব সুন্দরভাবে আলাদা আলাদা খুপরিতে গোছানো ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক এই স্থানে মোট ৪ টি প্রধান কক্ষ রয়েছে যার মধ্যে ৩ টি কক্ষে পোড়ামাটির সৈন্য এবং একটি কক্ষ শূন্য। তবে সমাধির বেশির ভাগ অংশ এখনও পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
নাজকা রেখা
দক্ষিণ পেরুর মরুভূমির উপর দিয়ে যখন বিমানে করে উড়ে যাওয়া হয়, তখন মরুভূমির বুকে অস্বাভাবিক কিছু সাদা রেখা অবলোকন করা যায় আর অদ্ভুত এই রেখাগুলোই নাজকা রেখা হিসেবে পরিচিত। ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে পেরুর এই স্থান অন্যতম। রহস্যময় প্রাচীন এই গঠন অনেকটা ট্রাপিজোয়েডাকার, আয়তাকার, ত্রিভুজাকার এবং স্ফুলিঙ্গের মত। যদি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয় তাহলে সেই নকশার মধ্যে ৭০ টি প্রাণী, গাছপালা এবং ৩০০ টি জ্যামিতিক আকৃতি খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে এই রেখাগুলো কি কারণে আঁকা তা এখনও রহস্যই রয়ে গেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা অনুযায়ী, নাজকা রেখাগুলো আঁকা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সাল থেকে ৭০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালের মধ্যে এবং এই রেখা গুলোর আঁকিয়ে ছিল নাজকা ইন্ডিয়ান আদিবাসীরা। অর্থাৎ প্রায় ২০০০ বছর ধরে অক্ষত আছে এই প্রাচীন অংকন। মানুষের একটি বিশাল সংখ্যা বিশ্বাস করে যে, সঠিক দিক নির্দেশের উদ্দেশ্য এলিয়েনদের দ্বারা এই রেখা গুলো অংকিত হয়েছে।
মাউন্ট ওয়েন মোওয়া
সময়টা ছিল ১৯৮৬ সাল যখন এক দল প্রত্নতাত্ত্বিক নিউজিল্যান্ডের এক গুহায় খনন করার সময় পাখির একটি দাঁড়া আবিষ্কার করে যে দাঁড়াটিতে হাড়ের সাথে তখনও মাংসপেশি সংযুক্ত ছিল। পরবর্তীতে পুরাতত্ত্ববিদগণ নিশ্চিত করেন যে, এই দাঁড়াটি বিলীন হয়ে যাওয়া পাখাবিহীন মোওয়া পাখির যা প্রায় ২০০০ বছর আগেই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে। ডানা বিহীন মোওয়া পাখি ছিল বেশ ভারি প্রজাতির পাখি যা উচ্চতায় ১২ ফুট এবং ওজনে ২৫০ কেজি পর্যন্ত হত। মূলত, প্রাচীন মানবদের শিকারে পরিণত হওয়ার কারণেই পৃথিবী থেকে মোওয়া পাখি বিলীন হয়ে গেছে। মোওয়া পাখির সেই দাঁড়াটি বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে (Natural History Museum of Newzeland) সংরক্ষিত আছে।
সাকারা নেক্রোপলিসের মমি
মিশর- যেখানে ছিল পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন সভ্যতা। ধারণা করা হয়, মিশরীয় সভ্যতার অনেক নিদর্শনই এখনো চাপা পড়ে আছে মরুভূমির বালির নিচে। ২০২০ সালের গ্রীষ্মে সেরকমই একটি আবিষ্কার করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। কায়রোর দক্ষিণে সাকারা মূলত একটি নেক্রোপলিস। যেখানে মিশর সভ্যতার অসংখ্য গণকবর রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আর সেই সাকারা থেকেই ১০০টি প্রাচীন কফিন উদ্ধার করেছেন মিশরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মকর্তারা।
কফিনগুলোর কয়েকটির মধ্যে সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় কিছু মমিও উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া, ৪০টি সোনার ভাস্কর্য-মূর্তি এবং প্রতিমা আবিষ্কৃত হয়েছে। কাঠের কফিন এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সমাহিত করা হয়েছিল টলেমাইক পিরিয়ডে, যা ৬৬৪ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪ শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
দুই দেবতার সংমিশ্রিত এক অবতার, মিশরীয় দেবতা পাতাহ-সেকারের মূর্তিও পাওয়া গেছে এ অঞ্চল থেকে। পাতাহ ছিলেন মেমফিসের দেবতা এবং সেকার (সোকার বা সাকার নামেও পরিচিত) ছিলেন সাকারার দেবতা। ধারণা করা হয়, সেই সময়টাতে মিশর বাইরের শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল; যেমন – আসিরিয়ান, পারসিয়ান এবং গ্রিক। এই প্রাচীন সমাধিস্থলে বিশ্বের সবচাইতে পুরনো ইলাস্ট্রেশন বই, রহস্যময় এক ব্যক্তির সমাধিকক্ষ এবং আরো অন্যান্য রহস্যময় জিনিসের সন্ধান মিলেছে। যেহেতু প্রাচীনকাল থেকে এখন অবধি মিশরের নিদর্শন চুরি ঘটনা চলমান, তা সত্ত্বেও এমন একটা আবিষ্কার সত্যিকার অর্থেই অবিস্মরণীয়।
ভোয়নিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট
একে বলা হয়ে থাকে “পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় ম্যানুস্ক্রিপ্ট”। ইতালির উত্তরে ১৯১২ সালে এই ম্যানুস্ক্রিপ্ট আবিষ্কৃত হয়। এই ম্যানুস্ক্রিপ্টের ভাষা, ব্যবহৃত বর্ণমালা বা এর লেখক সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোন প্রকার তথ্য খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, ম্যানুস্ক্রিপ্টির বেশ কিছু পাতা খুঁজে পাওয়া যায় নি এবং সব মিলিয়ে বর্তমানে মোট ২৪০টি পৃষ্ঠা বিদ্যমান।
ম্যানুস্ক্রিপ্টে প্রাপ্ত লেখনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে এর মধ্যে অংকিত বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদের চিত্র। মজার ব্যাপার এই যে, ছবির গাছের সাথে মেলে এমন কোন গাছ আজ অবধি গবেষকবৃন্দ খুঁজে পাননি। ধরে নেয়া হয়, ভোয়নিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট রচনার সময়কাল ১৫শ শতাব্দী। ভেষজ উদ্ভিদের অংশটি ছাড়াও ম্যানুস্ক্রিপ্টে বেশ কয়েকটি অংশ রয়েছে এবং তাদের মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা, জীববিদ্যা, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং ওষুধবিদ্যা অন্যতম।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ