সিডনিভিত্তিক জ্বালানিবিশেষজ্ঞ টিম বাকলি বলেছিলেন, এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশকে পাঁচ গুণ বেশি দাম দিয়ে আদানি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে এবং ‘চুক্তিটি বাংলাদেশের জনগণের টাকায় এশিয়ার সাবেক শীর্ষ ধনীর পকেট ভরার চুক্তি’। তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ রক্ষার আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছিলেন, ‘এটি কোনো চুক্তি নয়, বরং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী আদানিকে বাংলাদেশের দেওয়া উপহার।’
রামপাল চুক্তি ছিল একটি বিতর্কিত ও সমালোচিত চুক্তি। সুন্দরবনের কাছে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের এই চুক্তিটির সমালোচনা ছিল প্রধানত দুটি কারণে। এর পরিবেশগত ঝুঁকি এবং এতে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে ভারতীয় কোম্পানিকে বিদ্যুৎ সরবরাহের অযৌক্তিক সুবিধা দেওয়া।
এখন দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুতের দাম, বিদ্যুৎ ক্রয়ে বাধ্যবাধকতা, ক্যাপাসিটি চার্জ, বিরোধ নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আদানির সঙ্গে গোপনে সম্পাদিত চুক্তি, এমনকি রামপাল চুক্তির চেয়েও খারাপ। সবকিছু মিলিয়ে এই চুক্তিকে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। এবার এর হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া গেল। বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ মার্চের বিল (প্রথম বিল) জমা দিয়েছে আদানি পাওয়ার লিমিটেড (এপিএল)। চলুন জানা যাক কী আছে এই বিলে।
বিলের বিস্তারিত
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে (বিপিডিবি) চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ২০ মিলিয়ন (২ কোটি) ডলারের বিল জমা দিয়েছে আদানি গ্রুপ। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলার ১০৭ টাকা, বাংলাদেশ ব্যাংক) বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২১৪ কোটি টাকা। আদানিকে এ বিল ডলারেই পরিশোধ করতে হবে বিপিডিবির।
বিপিডিবিসংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র বিষয়টি বণিক বার্তাকে নিশ্চিত করেছে। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সংস্থাটির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মার্চের বিলটি ছিল পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদনের। সে হিসেবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ আদানির গড্ডা কেন্দ্রের বিল দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলারের মতো।
গড্ডা থেকে মার্চে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ আমদানির স্পষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম পড়েছে ১১ দশমিক ৪৮ সেন্ট (১২ টাকা ২৮ পয়সা)। এক্ষেত্রে শুধু জ্বালানি বাবদ ব্যয়কেই দাম হিসেবে ধরা হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জসহ অন্যান্য খরচ এতে যুক্ত করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ নেয়া হলে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে বিপিডিবি শুধু এনার্জি চার্জ বা জ্বালানির মূূল্য পরিশোধ করে থাকে। কেন্দ্রটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আসার আগ পর্যন্ত বিপিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ ও অন্যান্য খরচ বহন করতে হয় না।
আদানির গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ রপ্তানি শুরু করে গত ৯ মার্চ। এর প্রায় এক মাস পর ৭ এপ্রিল গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার বিষয়টি জানিয়ে ভারতীয় স্টক এক্সচেঞ্জকে একটি চিঠি দেয় আদানি পাওয়ার। এ অনুযায়ী, ক্যাপাসিটি চার্জ ও অন্যান্য ব্যয় যোগ করে বিপিডিবিকে বিদ্যুতের বাণিজ্যিক মূল্য পরিশোধ করতে হবে ৭ এপ্রিলের পর থেকে।
আদানির পাওয়ার-সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য এক সূত্র জানিয়েছে, মার্চে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ বিল জমা দেয়া হলেও কী প্রক্রিয়ায় তা পরিশোধ করা হবে, সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। এছাড়া এখনো দুই পক্ষের মধ্যে লেনদেনসংক্রান্ত ব্যাংকিং কার্যক্রমের (এলসিসহ) পদ্ধতিও ঠিক হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী বিপিডিবি কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছ থেকে কেনা বিদ্যুতের বিল জমা দিলে তা এক মাসের পরিশোধের মধ্যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসেবে আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ বিল জমা দেয়ার পর এরই মধ্যে প্রায় তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে।
ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গড্ডায় নির্মিত আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সক্ষমতা ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। কেন্দ্রটি শুধু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানির জন্যই নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটে এখন বাণিজ্যিক উৎপাদন চলছে। বাকি ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ইউনিটেও চলতি বছরের জুনে উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে আদানি গ্রুপের।
এর আগে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু নিয়ে ভারতীয় স্টক এক্সচেঞ্জে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এপিএলের কোম্পানি সেক্রেটারি দীপক এস পান্ডের স্বাক্ষর করা ওই চিঠিতে বলা হয়, বিপিডিবির সঙ্গে এপিএলের ২৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয়সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের নিট সক্ষমতা ৭৪৮ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট) আওতায় ৬ এপ্রিল অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তীব্র তাপদাহের মধ্যে দেশে আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাণিজ্যিকভাবে আমদানি শুরু হয়। একই সঙ্গে বিপিডিবির উৎপাদনও পৌঁছায় রেকর্ড পর্যায়ে। বিদ্যুৎ বিভাগসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য হলো আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে লোডশেডিং কম হয়েছে। এর সঙ্গে ওই অঞ্চলে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন কমিয়ে ব্যয় সংকোচনও সম্ভব হয়েছে।
আদানি পাওয়ারের পক্ষ থেকে গতকাল প্রকাশিত এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়, উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগের ১৬ জেলার মানুষকে প্রতি বছর গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটে ভুগতে হয়। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে অলস পড়ে থাকে ওই অঞ্চলের ছোট ও মাঝারি শিল্প-কারখানা। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আর্থিকভাবে লোকসানে পড়েন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। তবে আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে সম্প্রতি সে চিত্রটা বদলেছে। বিপিডিবি এখন আদানির পাওয়ার প্লান্ট থেকে রুটিন ভিত্তিতে দৈনিক প্রায় ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিচ্ছে।
আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত ১০৬ কিলোমিটার ডেডিকেটেড সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করেছে। এ কেন্দ্র থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বগুড়া সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ আসছে। এরপর তা উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
গড্ডা থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে এপিএলের পূর্ণ মালিকানাধীন আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেডের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) সই করে বিপিডিবি। বর্তমানে ওই চুক্তির ভিত্তিতেই কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করছে বিপিডিবি।
অর্ধেক দামে ভারত থেকে বিদ্যুৎ কিনেছে নেপাল
বাংলাদেশে রফতানির জন্য ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গড্ডায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে আদানি গ্রুপ। এজন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত ডেডিকেটেড সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এর আগে থেকেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কয়লার উচ্চমূল্য ও ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনা শুরু হয়।
এরই মধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করেছে নেপাল। এ বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে ভারতীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অটোমেটেড বাজার প্লাটফর্ম ‘ইন্ডিয়ান এনার্জি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড’ (আইইএক্স) থেকে। প্লাটফর্মটিতে বিদ্যুৎ কেনাবেচা হয় উৎপাদন কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। এতে বিতরণ কোম্পানিগুলোও প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সুযোগ পায়। সম্প্রতি আইইএক্সে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্য সুবিধা যুক্ত হয়েছে। প্লাটফর্মটিতে যুক্ত হওয়ার সুবাদে এখন প্রতিযোগিতামূলক দামে বিদ্যুৎ কিনতে পারছে নেপাল।
এখান থেকে ১৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে নেপাল। আবার এ প্লাটফর্মকেই কাজে লাগিয়ে দেশটি থেকেই ভারতে বিদ্যুৎ রফতানি হচ্ছে প্রায় ৩৮ মেগাওয়াট। আইইএক্স থেকে সুলভমূল্যের বিদ্যুৎ কিনতে স্থানীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি চার্জের মতো কোনো জটিলতা নেই। একইসঙ্গে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্য বাড়ানো গেলে উৎপাদনে নিয়ে আসা যাবে দেশের অব্যবহৃত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ