বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে মানুষের কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে শিম্পাঞ্জি ও বানর। এছাড়া ডলফিন, অক্টোপাস, কাক, কুকুর, বিড়াল, টিয়াপাখিরও বুদ্ধিমত্তা অন্যসব প্রাণীর চেয়ে উন্নততর। কিন্তু মানুষ খুব সহজে এসব প্রাণীদের নিজের পোষ মানাতে পারে। সেটা সম্ভব হয়েছে মানুষের সবচেয়ে উন্নত মস্তিষ্ক থাকার কারণে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি পৃথিবীর সকল প্রাণীর মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা থাকতো তাহলে কী হতো? অথবা হঠাৎ করে যদি পৃথিবীর সকল প্রাণী বিচারবু্দ্ধিসম্পন্ন হয়ে ওঠে তাহলে কী ঘটতে পারে? মানুষ কি তার আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে? অথবা পৃথিবীর সকল প্রাণী কি এরপরও কোনো একক প্রাণীর দ্বারা শাসিত হবে?
আপাতদৃষ্টিতে এটা কিম্ভুতকিমাকার এক প্রশ্ন। পৃথিবীর সকল প্রাণীর মানুষের মতো বোধসম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যায়, যদি কখনো এমন হয় অথবা পূর্বে থেকেই এমন হতো, তাহলে পৃথিবীর প্রাণীকূলে কী ঘটতো?
এই প্রশ্নের হাইপোথিটিক্যাল উত্তর হলো ‘বিশৃঙ্খলা’। সকল প্রাণীর সমান বুদ্ধিমত্তা থাকার অর্থ হলো একে অপরের উপর কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা করবে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের অধ্যাপক রবিন ডানবারের মতে- এমন হলে প্রাণীরা একে অপরকে হত্যা করবে।
মানবজাতির ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলেই সমান শক্তির কুফল সম্পর্কে বোঝা যায়। বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিরা একে অপরের উপর আধিপত্য বিস্তার করার জন্য লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করছে। কারণ মানুষ নিজেই অপরিচিত ও নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি এমন কারো প্রতি সদয় না।
মানুষ আগন্তুক কাউকে দেখলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক আচরণ করে। সেই হিসেবে সকল প্রাণীর যদি মানুষের সমান বুদ্ধিমত্তা হয় তাহলে কুকুরকে পোষ মানানো সম্ভব? কুকুর কি মানুষকে প্রভু মানবে?
এর অর্থ হলো অন্য প্রাণীদের মানুষের সমান বুদ্ধিমত্তা থাকলে তারা মানুষের একনায়কতন্ত্রকে আর মানবে না। বলা যায়, প্রাণীকূলে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন হলো এই যুদ্ধে জয়ের পাল্লা ভারী হবে কার পক্ষে? এক্ষেত্রে প্রাণীদের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
যেমন বর্তমান বিশ্বে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তাহলে মালদ্বীপের মতো দেশকে কিন্তু পরাশক্তি দেশসমূহ গণনায় ধরবে না। কারণ এদের সেনাবাহিনীই নেই। বিশেষ কিছু দেশ এই যুদ্ধে সামনের সারিতে থাকবে।
ঠিক তেমনি প্রাণীদের মধ্যে যদি যুদ্ধ শুরু হয় কিছু প্রাণী হিসাবের বাইরে থাকবে। উদাহরণ হিসেবে তৃণভোজীদের কথাই ধরা যাক। এদের দেহে শক্তি যোগানোর জন্য দিনের অধিকাংশ সময় ঘাস খেতে হয়। ফলে এরা অন্যদের সাথে যোগাযোগ, কোনো যন্ত্র তৈরি, নিজেদের সংস্কৃতির বিকাশ অথবা কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণের মতো সময় পাবে না। আবার যারা আমিষ খায় তাদেরও কিছু সমস্যা হবে। কারণ তাদের আমিষ সংগ্রহ করতেই বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতে হবে।
আবার হাঙর, ডলফিন কিংবা ঘাতক তিমি এই যুদ্ধের বাইরে থাকবে। কারণ তারা সমুদ্রের পানিতে বন্দী। তবে তারা অন্যান্য জলজ প্রাণীদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। একইভাবে অন্য যে সকল প্রাণী তাদের চেনা পরিবেশের বাইরে টিকতে পারে না তারা কখনোই বিশ্বজয় করতে পারবে না। তারা বড়জোর নিজেদের রাজ্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
তবে বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, নেকড়ে, হাতি ও গণ্ডারের মতো শক্তিশালী প্রাণীরা নিঃসন্দেহে মানুষকে চ্যালেঞ্জ করবে। প্রাথমিকভাবে তারা মানুষকে নিজেদের খাদ্যে পরিণত করবে। তবে শেষপর্যন্ত তারা মানুষের সাথে পারবে না। কারণ মানুষের কাছে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র।
যদি সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষের সমপরিমাণ অন্যদের বুদ্ধি থাকতো, তাহলে হয়তো মানুষকে এসব অস্ত্র তৈরির আগেই অন্য প্রাণীর নিয়মিত খাবারে পরিণত হতে হতো। কিন্তু যদি হঠাৎ করে বর্তমান সময়ে কিংবা ভবিষ্যতে সকল প্রাণীর মানুষের সমান জ্ঞানবুদ্ধি হয়, তাহলে বাঘ, সিংহ কিংবা হাতি লড়াইয়ে টিকতে পারবে না। এর বড় কারণ মানুষের হাতে থাকা উন্নত প্রযুক্তি।
কিন্তু পৃথিবীর ভয়ঙ্কর মাংসাশী প্রাণীদের চেয়েও বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবে আমাদের নিকটবর্তী প্রজাতির প্রাণীরা। বিশেষ করে শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং, বনোবো ও গরিলা। এই প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাছাকাছি। তারা খুব সহজেই মানুষের তৈরি কম্পিউটারে প্রবেশ করতে পারবে। এছাড়া শারীরিকভাবে তারা মানুষের থেকে তো এগিয়ে থাকবেই।
তারা খুব সহজেই মানুষের তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি করতে সক্ষম হবে। এমনকি তারা চাইলে আমাদের প্রযুক্তি হ্যাক করার মতো সক্ষমতাও অর্জন করতে পারবে!
তবে মানুষের নিকটবর্তী এসব প্রাণী, যাদের প্রাইমেট বলা হয়, তারা মানুষকে হটিয়ে বিশ্ব শাসন করবে এমন মনে করেন না সেন্ট অ্যান্ড্রুস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তাত্ত্বিক জোসেপ কল। তার মতে, প্রাইমেটদের আগে থেকেই যদি সকল জ্ঞানবুদ্ধি দেওয়া হতো, তাহলে মানুষের সাথে তাদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো। যেহেতু দেওয়া হয়নি, এখন যদি তারা এসব পায়ও তাহলে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। তবে প্রাইমেটরা অন্য সকল প্রজাতির উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না।
এছাড়া প্রাইমেটদের হঠাৎ করে বদলে যাওয়া পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। এটা মানুষ যত সহজে পারে, প্রাইমেটরা তা পারে না। তাদের পরিবর্তিত পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার পর মানুষকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। এর আগে অবশ্যই মানুষ তাদের মোকাবেলা করার পন্থা বের করবে। যেহেতু মানুষ এখন পর্যন্ত অন্য সকল প্রাণীদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
এবার ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জীবাণুদের বিষয়ে আসা যাক। কোনো ব্যাকটেরিয়ার স্নায়ুতন্ত্র নেই। তাই তারা বুদ্ধিমান প্রাণী হবে এমন ভাবনা খুবই অমূলক মনে হতে পারে। তাদের এই অক্ষমতা আমাদের জন্য আশীর্বাদ বটে। কারণ যেহেতু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সকল স্থানেই অবস্থান করছে। তারা যদি বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে, তাহলে তাদের মোকাবেলা করা খুবই কঠিন হবে।
এ বিষয়ে জোসেপ কলের বক্তব্য হলো, ব্যাকটেরিয়া সকল স্থানেই রয়েছে। এমনকি আমাদের দেহের অভ্যন্তরে। তাই তারা আমাদের জন্য খুবই শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হবে। মানুষ বড় সমস্যার মুখোমুখি হবে যদি তাকে বুদ্ধিমান ব্যাকটেরিয়ার সাথে লড়াই করতে হয়। বিশেষ করে যেটি আমাদের দেহের জন্য খারাপ। আমরা চাইলেও সব ব্যাকটেরিয়াকে মারতে পারবো না। কারণ আমাদের টিকে থাকার জন্যও ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
অন্যদিকে ডানবারের মতে, এই যুদ্ধে যদি খুবই ক্ষুদ্র প্রাণী জয়লাভ করে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখন যদি এই যুদ্ধে মানুষ হেরে যায় তাহলে কী হবে? যদি মানুষ হেরেও যায় এরপরও যুদ্ধ থামবে না। বরং তা অনন্তকাল ধরে চলমান থাকবে। কিন্তু এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে অন্য কোনো প্রাণী মানুষকে হারাবে। কারণ সকল প্রাণী যে সরাসরি মানুষকে প্রতিপক্ষ মনে করবে তেমন তো নয়। তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করবে। এমনকি স্বজাতির সাথেও যুদ্ধে লিপ্তে হবে।
তবে শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ বাস্তুতন্ত্রের জন্য বড় এক ক্ষতি বয়ে আনবে। পৃথিবীকে বড় এক ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত মানুষের জয় হবে। কারণ মানুষের চেয়ে কল্যাণময় আর কোনো প্রজাতি নেই। অন্য কোনো প্রাণী মানুষের মতো করে সমস্যার সমাধানও করতে পারবে না।
তবে এই বিশৃঙ্খল পরিবেশের শিক্ষা হলো, আমরা প্রকৃতিতে যে ভারসাম্য দেখতে পাই তা একমাত্র ক্ষমতার ভারসাম্যতার কারণেই সম্ভব হয়েছে। দুর্বল ও সবল প্রাণী আছে বলেই প্রাণীকূলে বিশৃঙ্খলা নেই। সবশেষে এটা বলা যায়, পৃথিবীর অন্য প্রাণী যদি মানুষের সমপরিমাণ বুদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তাহলে মানুষ বিলীন হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
এসডব্লিউএসএস/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ