বোয়েঁভিল-আঁ-উভর নামের এক রোমান ভিলার প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে একটি গবেষণা দল বেশ কয়েকটি গাধার দেহাবশেষ আবিষ্কার করেছেন, যা দেখে মনে হবে আমাদের পরিচিত গাধা এদের তুলনায় অনেকখানিই বামন।
ফ্রান্সের তুলুজের পুরপাঁ মেডিকেল স্কুলের সেন্টার ফর অ্যান্থ্রপোবায়োলজি অ্যান্ড জেনোমিক্সের পরিচালক লুডোভিক অরল্যান্ডো জানান, ‘এই গাধাগুলোর আকৃতি বিশাল। এই নমুনাগুলো জিনগতভাবে আফ্রিকার গাধার সাথে সংযুক্ত, যেগুলো বেশ কিছু ঘোড়ার চেয়েও বড় ছিল।’
অরল্যান্ডো গাধার কঙ্কাল থেকে ডিএনএ সিকোয়েন্স করে, এমন একটি প্রজেক্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গাধা কীভাবে গৃহপালিত পশু হলো এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, তা নিয়ে বিশাল এক গবেষণার ছোট একটি অংশ এটি। এই ধৈর্যশীল, বহুকর্মা জীবটির সাথে আমাদের মনুষ্যপ্রজাতি কীভাবে জড়িয়ে পড়ল, তা নিয়ে বেশ কিছু নতুন জ্ঞান পাওয়া গেছে এই গবেষণা থেকে।
অরল্যান্ডোর মতে, রোমান ভিলায় আবিষ্কৃত গাধার উচ্চতা ১৫৫ সেন্টিমিটার, যেখানে বর্তমানে গাধার গড় উচ্চতা মাত্র ১৩০ সেন্টিমিটার। আধুনিক গাধাগুলোর মধ্যে একমাত্র আমেরিকান ম্যামথ জ্যাক প্রজাতির পুরুষ গাধাগুলোই এর সাথে টক্কর দিতে পারে, যেগুলো বেশ বড় এবং প্রজননের কাজে ব্যবহৃত হয়।
বোয়েঁভিল-আঁ-উভর-এ পাওয়া দৈত্যাকার গাধাগুলোর সাথে রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও টিকে থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কম আলোচিত ভূমিকা থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন অরলান্ডো।
‘২য় থেকে ৫ম শতাব্দীর মধ্যে রোমানরা খচ্চর উৎপাদনের জন্য [ঘোড়ার সাথে ক্রসব্রিডিং করে] এই গাধাদের বংশবৃদ্ধি করেছিল, যারা সামরিক সরঞ্জাম ও পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তারা যদিও ইউরোপেরই ছিল, তবু তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আসা গাধার সাথে ব্রিড করানো হয়েছিল।’
কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সাথে সাথে সম্ভবত এই বিশাল গাধার জাতটিও অদৃশ্য হয়ে যায়। অরল্যান্ডো জানান, ‘আপনার যদি হাজার হাজার কিলোমিটারজুড়ে বিশাল সাম্রাজ্য না থাকে, তবে আপনার এমন কোনো প্রাণীর প্রয়োজন হবে না যা বিশাল দূরত্বে পণ্য বহন করবে। তাছাড়া খচ্চর উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো অর্থনৈতিক প্রণোদনা ছিল না।’
মানব ইতিহাসে গাধা কীভাবে তাদের ভূমিকা পালন করেছে, তা খুঁজে বের করার জন্য ৩৭টি গবেষণাগারের ৪৯ জন বিজ্ঞানীর একটি আন্তর্জাতিক দল জিনোম মডেলিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা বিশ্বের ৩১টি প্রাচীন ও ২০৭টি আধুনিক গাধার জিনোম সিকোয়েন্স তৈরি করেছে। এর ফলে তারা সময়ের সাথে গাধার শারীরিক পরিবর্তনগুলো বের করতে পেরেছেন।
গাধাগুলো প্রথম বন্য গাধা থেকে গৃহপালিত হয়েছিল প্রায় ৭ হাজার বছর আগে কেনিয়া এবং হর্ন অভ আফ্রিকায়, সম্ভবত যাজকদের মাধ্যমে। যদিও এর আগে মনে করা হতো গাধাকে গৃহপালিত করা হয়েছে আরও কিছু পরে, তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো আধুনিক সব গাধাই এখান থেকেই উদ্ভূত হয়েছে।
এর আগের গবেষণাগুলোতে আভাস দেওয়া হয় যে, গাধা গৃহপালিত হওয়ার সূচনা হয়েছিল ইয়েমেনে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো গাধার এই গৃহপালিত হওয়ার সময় সবুজ সাহারা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার সময়ের সাথে মিলে যায়।
সাহেল অঞ্চলে প্রায় ৮ হাজার ২০০ বছর আগে হঠাৎ করে বৃষ্টিপাত কমে যায়। তার সাথে যুক্ত হয় পশুচারণ ও পোড়ানোর মতো মনুষ্যঘটিত বিষয়। ফলে সাহারার মরুকরণ শুরু হয়। এই কঠোর পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য গাধার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে।
অরল্যান্ডো বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্থানীয়দেরকে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে। গাধাকে পোষ মানিয়ে তারা কঠিন পথে প্রচুর পরিমাণ ভার নিয়ে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করার সুযোগ লাভ করে।’
তারা লক্ষ করেছেন, গাধাকে পোষ মানানোর পর তাদের জনসংখ্যা দ্রুত কমে যেতে থাকে, তারপর আরও দ্রুত বাড়া শুরু হয়। ‘গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে এটি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং সব গৃহপালিত প্রানীর মধ্যেই এটি দেখা যায়’ বলে জানিয়েছেন সেন্টার ফর অ্যান্থ্রপোবায়োলজি অ্যান্ড জেনোমিক্স অফ টুলুসের পপুলেশন জেনেটিসিস্ট ইভলিন টড।
গৃহপালনের জন্য গাধার একটি নির্দিষ্ট প্রজাতি বাছাই করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্রিডিং করার ফলে প্রাথমিকভাবে এই হ্রাস ঘটে, যা পরবর্তীতে তাদের জনসংখ্যার বিশাল বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
গবেষণায় দেখা যায়, গাধার সংখ্যা এরপর পূর্ব আফ্রিকা থেকে কমে যেতে শুরু করে, অন্যদিকে উত্তর-পশ্চিমের সুদান ও মিশরে ব্যবসার কাজে পাঠানো হতে থাকে। মিশরের সাড়ে ৬ হাজার বছর আগের এক প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে গাধার অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। পরবর্তী আড়াই হাজার বছর ধরে এই নতুন গৃহপালিত জীব ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
অস্ট্রিয়ার গ্রাজ ইউনিভার্সিটির প্রত্নতাত্ত্বিক লারকে রেখটের মতে, গাধা মানব ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়েছে তাদের সহনশীলতা এবং দীর্ঘ পথ ধরে ভারী বোঝা বহন করার ক্ষমতার কারণে। এছাড়া তাদের পণ্য পরিবহনের সময়ের সাথে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের ব্রোঞ্জ যুগের উৎকর্ষের সময়ও মিলে যায়।
তিনি বলেন, ‘যদিও মেসোপটেমিয়ার ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস এবং মিশরের নীল নদের মতো নদীগুলো বিপুল পরিমাণ ভারী পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হতো, তবে স্থলপথে পরিবহনের জন্য গাধাই ছিল সবচেয়ে উপযোগী। ব্রোঞ্জ যুগে গাধাকে দিয়ে ভারী তামা (কপার) দীর্ঘ দূরত্বে নিয়ে যাওয়া হতো। মেসোপটেমিয়াসহ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় না (বা অল্প পাওয়া যায়), এমন জায়গায় তামা পরিবহনের কাজে গাধাকে ব্যবহার করা হতো।’
যুদ্ধে গাধার ভূমিকা নিয়েও আলোকপাত করেন রেখট। ‘যুদ্ধে অংশ নেওয়া চাকাযুক্ত যানবাহনের সামনে গাধা যুক্ত করা শুরু হয়, তাছাড়া একটি আক্রমণকারী বাহিনীর পেছনে পেছনে তাদের প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের জন্যও গাধাকে ব্যবহার করা হতো।’
গাধা এতটাই মূল্যবান ছিল যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানেও এদের ব্যবহার শুরু হয়। রেখট জানান, ‘মিশর ও মেসোপটেমিয়াতে গাধাকে মানুষের সাথে সমাধিস্থ করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজা বা শাসকদের সাথেও। কখনও কখনও গাধাকে আলাদাভাবে সমাধিস্থ করার প্রমাণও পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে চুক্তি স্বাক্ষরের আচার হিসেবে গাধাকে বলি দেওয়ারও প্রমাণ রয়েছে।’
অরল্যান্ডো ও তার সহকর্মীদের গবেষণা করা সবচেয়ে পুরোনো নমুনা ছিল তুরস্ক থেকে পাওয়া ব্রোঞ্জ যুগের তিনটি গাধা। টড জানান, ‘রেডিওকার্বন পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখা যায়, এগুলো সাড়ে চার হাজারের বছরের পুরোনো। এছাড়াও আধুনিক এশীয় গাধাগুলোর মতো এদের জেনেটিক মেকআপ রয়েছে।’
এই সময়ের কাছাকাছি সময় থেকেই অন্যান্য বংশ থেকে এশীয় গাধাগুলো বিভক্ত হয়ে যায় বলে মনে করা হচ্ছে গবেষণার ফলাফল থেকে।
গবেষণা থেকে আরও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ঘোড়ার আগে থেকেই গাধা মানূষের সঙ্গী ছিল। ‘আধুনিক ঘোড়া, যা প্রায় ৪ হাজার ২০০ বছর আগে গৃহপালিত হয়েছিল, মানব ইতিহাসে বড় প্রভাব ফেলেছে। তবে এখন আমাদের গবেষণায থেকে দেখা যায় যে, গাধার প্রভাব ফেলেছে আরও বেশি সময় ধরে।’
প্রাণীটির দীর্ঘস্থায়ী উপযোগিতা মানুষের যে পরিমাণ উপকারে এসেছে, সে হিসেবে ঘোড়া এবং কুকুরের তুলনায় এটি খুব কম মনোযোগই পেয়েছে। যদিও বিশ্বের অনেক জায়গায় এখন গাধাকে উপেক্ষা করা হয়, তারপরও বিশ্বের কিছু জায়গায় তারা এখনও আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
এসডব্লিউএসএস/১৯০৫
আপনার মতামত জানানঃ