১৯৬৪ সালে চিনের পূর্ব উপকূলের শ্যানডং প্রদেশের শুয়োংয়াং শহরে চলছিল নির্মাণ প্রকল্প। তবে মাটি খুঁড়তে গিয়েই রীতিমতো চমকে গেলেন নির্মাণকর্মীরা। সার দিয়ে সাজানো রয়েছে একের পর এক কঙ্কাল।
তাও যদি এসকল কঙ্কাল মানুষের হত, না-হয় বোঝা যেত সেখানে সমাধিক্ষেত্র ছিল এককালে। কিন্তু এ যে ঘোড়ার কঙ্কাল! এতগুলো ঘোড়ার একসঙ্গে মৃত্যু হল কীভাবে তবে? কেনই বা তাদের একত্রে সমাধিস্থ করা হল এই অঞ্চলে?
এই আশ্চর্য সমাধি আবিষ্কার সে-সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা দুনিয়ার প্রত্নজগতে। চিন তো বটেই, বিদেশ থেকেও বহু প্রত্নতাত্ত্বিক ছুটেছিলেন আশ্চর্য এই সমাধিক্ষেত্র প্রত্যক্ষ করতে। তবে এই রহস্যের সমাধান সামনে আসতেই লেগে যায় কয়েকবছর।
না, এই সমাধির সঙ্গে ঘোড়ার গণমৃত্যুর যোগ নেই কোনো, বরং নিরীহ প্রাণীগুলিকে হত্যা করা হয়েছিল কেবলমাত্র এক চৈনিক রাজার শেষকৃত্যের সময়।
শুরু থেকেই বলা যাক এই ঘটনা। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। পূর্ব-চিনে তখন চি সাম্রাজ্যের শাসন। আর এই বংশেরই অন্যতম সম্রাট ছিলেন ডিউক জিং।
৫৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত চিনে রাজত্ব ছিল তাঁর। তবে মজার বিষয় হল, রাজা হওয়ার কোনো কথাই ছিল না তার। বরং, তার বাবা জিং-এর মৃত্যুর পর রাজা হয় তার সৎদাদা ডিউক জিয়াং।
তবে প্রধানমন্ত্রীর চক্রান্তে মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই মৃত্যু হত তার। অন্যদিকে যৌবনে পা দেওয়ার আগেই সিংহাসনে বসতে হয় জিয়াং-কে। সে-সময় আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি রাজা থাকলেও, রাজ্য শাসনের সমস্ত ভার ছিল প্রধানমন্ত্রী কুই ঝু এবং কিং ফেং-এর নিয়ন্ত্রণে। তা নিয়ে গোটা রাজ্যও বিভক্ত হতে বসেছিল দুটি মেরুতে।
আরেকটু পরিণত হলে শক্ত হাতেই দেশের শাসনব্যবস্থার হাল ধরেন জিয়াং। বরখাস্ত করেন দুই প্রধানমন্ত্রীকেই। দ্বীপান্তরে পাঠানো হয় তাদের। শান্তি ফেরে তার সাম্রাজ্যে। তবে চি সাম্রাজ্যকে সমৃদ্ধির মধ্যগগনে পৌঁছে দিলেও, তাঁর যোগ্য উত্তরসূরির অভাবই নড়বড়ে করে তুলেছিল চি-রাজত্বকে।
সন্তান যে ছিল না তার, এমনটা নয়। পাঁচ-পাঁচটি সন্তান। তবে তাদের মধ্যে প্রথম চারজনই ছিলেন বিলাসপ্রিয়। অন্যদিকে কনিষ্ঠ সন্তান সিংহাসনলাভের যোগ্য হলেও, তার মা নিম্নবর্ণের মহিলা হওয়ায় ‘রাজপুত্র’ হিসাবে মানতে নারাজ ছিলেন নাগরিকদের একাংশ।
তবে কনিষ্ঠপুত্রকে রাজার মুকুট পরাতে কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জিয়াং। জীবদ্দশায় নিজের প্রথম চার পুত্রকেই পাঠিয়েছিলেন নির্বাসনে। তবে তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং, তার মৃত্যুর পরই গোটা রাজ্য ছড়িয়ে পড়ে বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, গৃহযুদ্ধ।
জিয়াং-কে যোগ্য সম্মান দিয়ে সমাধিস্থ করার সুযোগটুকুও হয়নি, এমনটাই দাবি গবেষকদের একাংশের। আর যে ঘোড়ার সমাধির কথা হচ্ছিল এই লেখার শুরুতেই, সেই ঘোড়াগুলিও ছিল নাকি তারই বাহন। রাজার মৃত্যুর পর তাদেরও হত্যা করা হয়েছিল।
সত্তরের দশকে এমনটাই মনে করতেন গবেষকরা। তখনও পর্যন্ত সবমিলিয়ে প্রায় ১২০টি ঘোড়ার কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছিল শুয়োংয়াং শহরে। তবে তারপর বিভিন্ন রাজনৈতিক জটিলতার কারণে বন্ধ হয়ে যায় খননকাজ।
চলতি শতকের শুরুতে এই খনন প্রকল্প শুরু হলে ফের আবিষ্কৃত হয় আরও ১৩১টি ঘোড়ার কঙ্কাল। ফলে, মোট অশ্বসমাধির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫১। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিশ্বাস মোট ৬০০টি ঘোড়া সমাধিস্থ করা হয়েছিল এই অঞ্চলে।
৬০০টিই কেন? কারণ পরবর্তী সময়ের গবেষণা গল্পটা একটু অন্যরকমভাবে বলে। আধুনিক গবেষকদের মতে, ঘোড়াগুলিকে হত্যা নয়, বরং বলি দেওয়া হয়েছিল রাজা জিয়াং-এর সম্মান জানাতে। রাতে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের। তারপর মাথায় আঘাত করে মারা হয়েছিল মুগুর দিয়ে।
এধরনের বলির প্রথা প্রচলিত ছিল তৎকালীন চিনে। ঘোড়া না হলেও ছাগল কিংবা ভেড়া বলি দেওয়া হত বহু ধর্মস্থানে। আর সেক্ষেত্রে সংখ্যাটা ছিল ৬০০। তাছাড়া পোষ্য ঘোড়া ছাড়া সমাধিস্থ করা হয়েছিল রাজার ব্যবহৃত বেশ কিছু সামগ্রী। চলতি শতকের প্রথম দশকেই সন্ধান মিলেছে এধরনের ৩০০০ সামগ্রীর। ফলে, জনরোষেই হত্যা করা হয়েছিল রাজার বাহনগুলিকে, এই যুক্তি টেকে না মোটেই।
তবে আজও চিনের এই অশ্বসমাধি রহস্যের সম্পূর্ণ সমাধান মেলেনি বলেই দাবি গবেষকদের। তার একটি কারণ, প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী ৬০০টি ঘোড়ার কঙ্কাল থাকার কথা। যা আজও আবিষ্কৃত হয়নি পুরোপুরিভাবে।
দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ ঘোড়ার বয়সই ছিল ৫-৭ বছরের মধ্যে। ফলে সেগুলি যে প্রত্যেকটিই রাজা জিয়াং-এর পোষ্য ছিল, তাই বা বলা যায় কোন যুক্তিতে? এইসব হাজার প্রশ্ন নিয়েই আজও রহস্যের কুহকে মুড়ে রয়েছে চিন তথা বিশ্বের সর্ববৃহৎ অশ্বসমাধিস্থল ‘শুয়োংয়াং’।
এসডব্লিউএসএস/২১৩৫
আপনার মতামত জানানঃ