গতকালকের খবরের সূত্র মতে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গুলিস্তান এলাকার কাছে সিদ্দিক বাজারে একটি বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ১৬ জন নিহত এবং শতাধিক মানুষ হতাহত হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার বিকাল পৌনে পাঁচটার দিকে ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে পাশাপাশি আরও দুটি বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মাত্র দুইদিন আগে ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটি ভবনে বিস্ফোরণে তিনজন নিহত আর অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শতাধিক ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এখানে ১৬ জনের মৃতদেহ রাখা হয়েছে।
সাম্প্রতি ঢাকার সাইন্সল্যাব এলাকায় একটি তিনতলা বাণিজ্যিক ভবনে ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি অক্সিজেন কারখানায় বড় বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন হতাহতের ঘটনায় আবারও সামনে এসেছে একটি প্রশ্ন। আর তা হল, এ ধরণের দুর্ঘটনার পেছনে দায় কাদের?
এই দুটি ঘটনার বাইরেও বিগত কয়েক বছরে বড় ধরণের বিস্ফোরণের খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। তবে সবকটি বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে ‘জমে থাকা গ্যাসের’ বিষয়টিকে দায়ী করা হচ্ছে।
এর মধ্যে কয়েকটির দুর্ঘটনার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। যে কটির তদন্ত প্রতিবেদন সামনে এসেছে সেখানে বিস্ফোরণের পেছনে মূলত দায়ী করা হয়েছে ভবন বা প্রতিষ্ঠানের মালিককে।
ঘটনার তদন্তে কর্তৃপক্ষের অবহেলা প্রকাশ্যে এলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। বেশিরভাগ সময় দায় চাপিয়ে দেয়া হয় ভবন মালিকের উপর।
ফায়ার সার্ভিসের দাবি, জনগণের অসচেতনতার কারণেই বার বার এ ধরণের ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার আগে প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
যা জানা যাচ্ছে
রবিবার সকালে ঢাকার সাইন্সল্যাব এলাকায় একটি তিনতলা বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণ অন্তত তিন জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন।
পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারি দল ভবনটি পরিদর্শন করে জানিয়েছেন, ওই ভবনে কোন না কোনভাবে জমে থাকা গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণ হয়েছে। এই গ্যাস পয়ঃনিস্কাশন লাইন থেকে লিক হতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন।
এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের হয়নি।
সাইন্সল্যাবের এই ঘটনা ২০২১ সালের ২৭শে জুন মগবাজারে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেখানেও তিন তলা ভবনের নীচতলায় জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছিল।
ওই ঘটনায় ভবনের নীচতলায় কোনও গ্যাস সংযোগ পাওয়া যায়নি, গ্যাস সিলিন্ডারও অক্ষত ছিল৷ সেসময় বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, তারা সেখানে মিথেন গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন যা পয়ঃনিষ্কাশন লাইন থেকে লিক হতে পারে।
এছাড়া ২০২০ সালের চৌঠা সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণ ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
তদন্ত সংস্থা সিআইডি বিস্ফোরণের কারণ উদঘাটন করে জানায়- মসজিদের ভেতরে গ্যাস ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ছিল। গ্যাস লাইনের লিকেজ দিয়ে বের হয়ে আসা গ্যাসের ওপর বিদ্যুতের স্পার্ক পড়তেই বিস্ফোরণ ঘটেছে৷
অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক কর্মকর্তা এ কে এম শাকিল নেওয়াজ জানিয়েছেন, সাধারণত কোন আবদ্ধ জায়গায় যদি গ্যাসের মাত্রা ৫% থেকে ১৭% হয় তাহলে কোনোভাবে আগুনের স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শ পেলেই বিস্ফোরণ ঘটে।
এই আগুন দেশলাই, জ্বলন্ত সিগারেট, লাইন ফ্যানের সুইচের সামান্য স্পার্ক থেকেও হতে পারে। সাধারণত গ্যাসলাইনগুলো লিক করলে মাটির বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে সেই গ্যাস পানি বা পয়নিষ্কাশন লাইনে মিশে যেতে পারে।
সেই পাইপ বেয়ে গ্যাস উঠে যায় বহুতল ভবনে। সেখানে যদি পরিবেশ আবদ্ধ থাকে, তাহলে গ্যাস জমতে জমতে বিস্ফোরণের আশঙ্কা তৈরি হয়।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে গত বছরের চৌঠা জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। সেখানে বেসরকারি একটি কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। দগ্ধ হয়েছিলেন অন্তত দুই শতাধিক।
কন্টেইনারে রাসায়নিক থেকে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনার তিন দিন পর পুলিশ বাদী হয়ে আট কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে মামলা করলেও এখন পর্যন্ত এ মামলায় কেউ গ্রেফতার হয়নি। শেষ হয়নি মামলার তদন্তও।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছিল, বিএম কনটেইনার ডিপোতে ড্রামভর্তি কেমিক্যাল কনটেইনারে থাকার কথা ফায়ার সার্ভিসকে জানায়নি মালিকপক্ষ। এ কারণে সেখানকার আগুন পানিতে নেভানো সম্ভব হয়নি। ফলে আগুন ছড়িয়ে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
এই ঘটনার তদন্ত চলাকালীন অবস্থাতেই গত চৌঠা মার্চ সীতাকুণ্ডে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটে। এতে এখন পর্যন্ত ছয়জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। তদন্ত এখনও চলমান। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, অক্সিজেন প্ল্যান্টের বয়লার থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে।
তবে বিস্ফোরণের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ ভারী এসব কারখানায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুললেও কোন মামলা দায়ের হয়নি। মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
দায় কাদের?
এই প্রতিটি বিস্ফোরণের ঘটনার পর পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন৷ প্রতিবারই একটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
রিপোর্ট দেওয়ার জন্য কমিটিগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়৷ কিন্তু অনেক সময় তদন্ত প্রতিবেদন আসতেই লম্বা সময় পেরিয়ে যায়।
আবার প্রতিবেদনে তদন্তের ফলাফল সামনে এলেও দুর্ঘটনার সকল দায় শেষ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি, ভবন মালিক, কারাখানা মালিক বা মসজিদ কর্তৃপক্ষের ওপরেই চাপানো হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অপারেশন্স বিভাগের পরিচালক তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “মানুষ ভীষণ অসচেতন, তারা ব্যস্ততার অযুহাত দিয়ে গ্যাসের লিকেজ ঠিক করে না, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বদলাতে চাই না। বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখি না। এভাবে আমরা ঝুঁকি তৈরি করছি। কিন্তু এতো ঘটনার পরও কারও টনক নড়ে না।”
বিস্ফোরণ ও অগ্নি দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন ভবন পরিদর্শনে তিনি জানতে পেরেছেন, ফায়ার সার্ভিস বা সিটি করপোরেশন থেকে অগ্নি নিরাপত্তা মেনে যে নকশা পাস করা হয়, ভবনটি সেই মোতাবেক বানানো হয়নি। অন্তত ৭০ ভাগ ভবনে তিনি এই ব্যত্যয় হতে দেখেছেন।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া বা কাউকে নিয়ম মানতে চাপ দেয়ার কোন এখতিয়ার ফায়ার সার্ভিসের নেই বলে তিনি জানান।
আবার যাদের গাফেলতির তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তাদের কারও বিরুদ্ধে তড়িৎ কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
কিন্তু একটি ভবনের নকশা অগ্নি নিরাপত্তা মেনে করা হয়েছে কিনা, আগুন নেভানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে কিনা, সেইসাথে কেমিকেল মজুদ বা কারখানার লাইসেন্স দেয়ার সময় পর্যাপ্ত নজরদারি ছিল কি না সেগুলো নিয়মিত তদারকি করার নিয়ম সরকারি সংস্থাগুলোর।
আবার কোন ভবনে অবৈধ বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সংযোগ কিভাবে এলো, এই অক্সিজেন কারাখানা নিয়ম মেনে পরিচালিত হচ্ছিল কিনা, কন্টেইনার ডিপোতে এতো ক্যামিকেলের মজুদ কিভাবে হল, সেটা নিয়ে কোন আলোচনা দেখা যায়নি।
এসব বিষয় তদারকি করা সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলেও বার বার তাদেরকে দায় এড়াতে দেখা গিয়েছে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থার মধ্যে রয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরণ পরিদপ্তর, পরিবেশ অধিদফতর এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া ব্যাংক এবং ইনস্যুরেন্স কোম্পানিও দায়বদ্ধ থাকে।
কিন্তু তদন্ত শেষে ভবন বা প্রকল্পের মালিক ছাড়া আর কাউকেই দায়ী করতে দেখা যায়নি। আবার গাফেলতির অভিযোগে দায়ী মালিককে শাস্তির আওতায় আনার নজিরও বিরল।
এর কারণ হিসেবে অগ্নি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এ কে এম শাকিল নেওয়াজ জানান, সংশ্লিষ্ট এই সংস্থাগুলোকে তদন্ত কমিটিতে রাখার কারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, “এখানে যাদের গাফেলতি থাকতে পারে তারাই যদি কমিটিতে থাকেন তাহলে সেখানে নিরপেক্ষ তদন্ত আশা করা যায় না।”
এক্ষেত্রে অগ্নি নিরাপত্তা, রসায়ন, বিস্ফোরক, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ দুর্ঘটনা সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। যারা শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।
এতে মালিকপক্ষের সমস্যার পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যত্যয়ের জায়গাগুলো উঠে আসবে। সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেলে সংশোধনে চাপ সৃষ্টি করা যাবে বলে তিনি মনে করেন।
নেওয়াজ জানান, “আমাদের এখানে মনিটরিংয়ের জায়গায় বড় ঘাটতি রয়েছে। আবার এতো সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও রয়েছে। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি থাকলে দায়িত্বে অবহেলার জায়গাগুলো আর থাকবে না।”
সেইসাথে তিনি সচেতনতার ওপরেও জোর দিয়েছেন। প্রথমত গ্যাসের লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং যেখানে গ্যাস জমার আশঙ্কা রয়েছে যেমন রান্নাঘর বা টয়লেটে যেন বিশুদ্ধ বাতাস চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে। কোন আবদ্ধ জায়গায় গ্যাসের গন্ধ পেলে লাইন ফ্যান জালানোর আগে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা।
তিনি আরও বলেন, “রানা প্লাজার ঘটনার পর যখন বিদেশের বায়াররা শর্ত জুড়ে দিল যে গার্মেন্টসের ফায়ার সেফটির না থাকলে তারা পোশাক কিনবে না। তখনই রাতারাতি এসব প্রতিষ্ঠানের চেহারা বদলে গিয়েছে। আমাদেরও সমন্বিতভাবে নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে এক হওয়া দরকার।”
এসডব্লিউএসএস/১১১০
আপনার মতামত জানানঃ