ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিলেই খেলাপি হবে না—এমন সুযোগ দেওয়ার পর শেষ প্রান্তিকে কিছুটা মন্দ ঋণ কমলেও বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। রবিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত ডিসেম্বর-২০২২ প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বর খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ হিসাবে ২০২২ সালে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। তবে ত্রৈমাসিকের তুলনা করলে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ১ দশমিক ২০ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিলের নতুন নীতি বাস্তবায়ন এবং পরিশোধের সুযোগ শিথিল করায় খেলাপি কমেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয় এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এই হিসেবে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা কমেছে।
গত বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ডিসেম্বর শেষে মোট খেলাপি ঋণের ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ।
গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ডাউন পেমেন্ট কমানো এবং পুনঃপরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর পর থেকে ঋণ পুনঃতফসিল প্রায় ৫০ শতাংশ হারে বাড়ে। এদিকে ব্যাপক ঋণ পুনঃতফসিলের ফলে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমলেও, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এধরনের ঋণকে দুর্বল সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। চলতি বছরে বছরের জুন থেকে খেলাপি ঋণের তথ্যসহ পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ জানাতে বলেছে।
আইএমএফ জানায়, ঋণ পুনঃতফসিলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সর্বোত্তম চর্চাকে চলতি বছরের জুন থেকে গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটের দুর্বলতা দূর করতে চলতি বছরের জুনের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি সার্বিক ও সময়নিষ্ঠ খেলাপি ঋণ নিষ্পত্তির কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যা আইএমএফ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পারফরম্যান্সের মানদণ্ড হিসাবে নির্ধারণ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের গড় খেলাপি ঋণের অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য তা ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনবে।
কোন ব্যাংকের পরিস্থিতি কেমন?
ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ও বেসিক- এই ছয় ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। এটা বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকগুলো দুই লাখ ৭৮ হাজার ৪২১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
সেপ্টেম্বর শেষে এই ৬ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৬০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।
জুনে এই ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
আর মার্চ শেষে এই ছয় ব্যাংকের মোট ঋণ ছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৪৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫৬ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে এক লাখ ১০ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা।
সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। এর আগে জুন শেষে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ০১ শতাংশই খেলাপি হয়ে আছে।
আর মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ৫৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
কৃষি, প্রবাসীকল্যাণ ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন- বিশেষায়িত এই তিন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। এই অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ।
সেপ্টেম্বরে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
জুনে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। মার্চে এই তিন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এই অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ০১ শতাংশ।
বিদেশি মালিকানার ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। এসব ব্যাংকের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ হাজার ৪৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ।
এসব ব্যাংকের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
জুনে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। এর আগে মার্চে এই ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এসডব্লিউএসএস/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ