আজ থেকে চার-সাড়ে চার হাজার বছর আগে, বা তারও আগে পশ্চিম ভারতীয় ভূখণ্ডে খোলা প্রান্তরে পড়ে থাকত মানবদেহ। আর সে-সব ঠুকরে খেত চিল-শকুনে। কুকুর কিংবা হিংস্র শেয়ালরা মেতে উঠতো বনভোজনে।
তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সভ্যতারগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের হরপ্পা তথা সিন্ধু সভ্যতা। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মাঝে অন্যতম সভ্যতা হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতা যা ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতার একটি নিদর্শন স্বরূপ ৷ আনুমানিক ৩৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সিন্ধু নদ অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল বলে সভ্যতাটির নাম রাখা হয় সিন্ধু সভ্যতা ৷ প্রাচীন ভারতে সর্বপ্রথম হরপ্পায় খননকার্য হয় বিধায় অনেকে একে হরপ্পান সভ্যতা হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। যদিও এখন আর শুধু সিন্ধু নদ কিংবা হরপ্পায় সীমাবদ্ধ নেই বরং বহুসংখ্যক প্রত্নস্থান আবিষ্কৃত হওয়ায় বর্তমান ভারত ও পাকিস্তানের বিশাল এলাকা জুড়ে এ সভ্যতার বিস্তৃতির প্রমাণ পাওয়া যায় ৷
আর সেখানেই প্রচলিত ছিল এই আশ্চর্য রীতি। যা পরিচিত ‘ফ্র্যাকশনাল বারিয়াল’ বা ‘আংশিক সমাধি’ (Fractional Burial) নামে। কী এই আংশিক সমাধি?
সাধারণত, মৃত ব্যক্তির দেহ খোলা আকাশের নিচে রেখে দিয়ে আসা হত পশু-পাখিদের খাদ্য হিসাবে। কয়েক সপ্তাহ পর দেহের অবশিষ্টাংশ অর্থাৎ হাড়-গোড় ফের সংগ্রহ করে আনতেন সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ। তারপর তা মাটির মাত্রে করে সমাধিস্থ করা হত মাটির তলায়। কোথাও আবার মাটির পাত্র ব্যবহৃত হত না, বরং মাটিতে গর্ত করে তুলে দেওয়া হত ইটের দেওয়াল। তার ভেতরেই সমাধিস্থ হত দেহ।
এই গল্প শুনে ভ্রূ-কুঞ্চিত হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, বহু মানুষেরই বিশ্বাস, সিন্ধু সভ্যতার প্রচলিত ছিল হিন্দু ধর্ম। আর তেমন হলে যে মৃতদেহ দাহ করাই নিয়ম। তবে? না, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। সেখানকার মানুষ টোটেম-পুজা, অর্থাৎ প্রাণী, প্রকৃতি এবং জড়ের পুজো করতে অভ্যস্ত ছিল।
উপাসনা করত যোনি ও লিঙ্গ মূর্তির, পশুপতির। তবে সিন্ধু সভ্যতায় আদতে কোনো ধর্মের প্রচলন ছিল কিনা, তার প্রমাণ মেলেনি কোনো। আর এই একই দৃশ্য দেখা যায় সমাধিস্থকরণ বা শেষকৃত্যের ভিন্ন ভিন্ন রীতিতেও।
সিন্ধু সভ্যতার একাধিক ধরনের সমাধিস্থকরণের রীতির হদিশ মিলেছে এখনও পর্যন্ত। কোথাও দেহ দাহ করা হত মৃত্যুর পর। কোথাও আবার, সমাধিস্থ করা হত দেহ। তাছাড়াও বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিলেছে স্ত্রী ও পুরুষ দেহ একসঙ্গে দাফন করার প্রমাণও।
আর এই তিন পদ্ধতির বাইরে চতুর্থ পদ্ধতিটি হল ‘ফ্র্যাকশনাল বারিয়াল’। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, কেবলমাত্র দেহের অবশিষ্টাংশ দেখেই কীভাবে বলা যায় সেগুলিকে ঠুকরে খেয়েছে কাক-শকুনে?
এক্ষেত্রে এভিডেন্স বা প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্ট মৃতদেহগুলির হাড়ের অবশিষ্টাংশ। এধরনের সমাধির ক্ষেত্রে হাড়ে পশুর দাঁত কিংবা পাখির চঞ্চুর দাগ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। তাছাড়াও অনেকক্ষেত্রেই সমাধির মধ্যে দেহের সম্পূর্ণ অস্থির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর তা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় ব্যাপারটা।
মূলত, সিন্ধু সভ্যতার পশ্চিম ও দক্ষিণে দেখা মিলত এই ধরনের সমাধিস্থকরণ রীতির। বর্তমান পাকিস্তানের খাইবারপাখতুনওয়ার সোয়াট ভ্যালিতে অবস্থিত ‘বারিকোট’, বালুচিস্তানের ‘খাদিরবেট’ এবং ভারতের গুজরাটের ধোলাবিরায় পাওয়া গেছে এধরনের সমাধির অস্তিত্ব।
মজার বিষয় হল, ‘ফ্র্যাকশনাল বারিয়াল’-এর এই আশ্চর্য রীতি শুধু প্রাচীন ভারতেই নয়, তা আজও প্রচলিত রয়েছে কোথাও কোথাও। মূলত পার্সিরা মৃত্যুর পর তাদের দেহ কাক-পক্ষীদের খাদ্য হিসাবে ফেলে রেখে আসেন প্রকৃতিতে।
বিশ্বের অন্যান্য জায়গা, উত্তর-পশ্চিম ভারত তো বটেই, এমনকি আঠারো শতকে কলকাতার বুকেই প্রচলিত ছিল এধরনের সমাধিস্থ করার রীতি। ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’-এর গল্প পড়লেই জানতেই পারবেন সেই ইতিহাস।
এবার প্রসঙ্গ থেকে একটু সরে গিয়ে, অন্য একটা বিষয়ে খানিক ভাবা যাক। ভারতীয় সংবিধান খুললেই চোখে পড়বে, আমাদের দেশ সেকুলার। সেকুলার অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের মানুষ সহাবস্থান করতে পারেন ভারতে। নিজের নিজের বিশ্বাস, রীতি পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে তাঁদের।
আজ থেকে চার-সাড়ে চার হাজার বছর আগেও কি এই একই রীতি প্রচলিত ছিল না ভারতীয় ভূখণ্ডে? সিন্ধু সভ্যতার সমাধিস্থকরণের বৈচিত্র্য একভাবে সেরকমই ইঙ্গিত দেয় যেন। আরও আশ্চর্য বিষয় হল, সে-সময় হিন্দুধর্ম, ইসলাম কিংবা জোরোয়াস্ট্রিয়ানিজম (পার্সি ধর্ম)—বিকশিত হয়নি কোনোটাই।
অথচ, এই তিন ধর্মের সমাধিস্থকরণের প্রথাই সহাবস্থান করত প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার বুকে। এও এক আশ্চর্যের বিষয়। সেদিক থেকে, কোথাও গিয়ে এ সম্ভাবনাও বোধহয় থেকে যায় যে এক মাটিতেই স্থাপিত হয়েছিল এই তিন ধর্মের ভিত্তিপ্রস্তর। অবশ্য এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেননি কোনো ইতিহাসবিদই। তবে আজ থেকে কয়েক দশক পর যদি এমনটা প্রমাণও হয়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার নেই কিছু।
এসডব্লিউএসএস/১৮১০
আপনার মতামত জানানঃ