বিদ্যালয় শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া গৌতম আদানি হয়েছেন এশিয়ার শীর্ষ ধনী। কিন্তু গত সপ্তাহে যা ঘটে গেছে, তাতে করে ভারতের এই নাগরিক তার ব্যবসায়িক ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।
বিশ্বের অন্যতম এই ধনী ব্যক্তির জন্য এ সপ্তাহটা ছিল রোলারকোস্টারের মতো। নিজের চোখের সামনেই তিনি দেখলেন তার প্রায় ২৫০০ কোটি ডলারের ব্যক্তিগত ধনসম্পদ উধাও হয়ে গেছে।
গত তিন বছরে তার বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম দশগুণ বেড়ে যাওয়ায় ৬০ বছর বয়সী এই ভারতীয় ব্যবসায়ী এশিয়ার সবচেয়ে ধনী এবং বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন।
কিন্তু এ সপ্তাহেই নিউইয়র্ক-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চের বিতর্কিত এক রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর গৌতম আদানির মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের মূল্যে ধস নামে।
ফোর্বসের ধনীদের তালিকায় তিনি ৩ নম্বর থেকে সাতে নেমে গেছেন। শুধু সম্পদই কমেনি আদানির, তার ব্যবসার ধরন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, খ্যাতি বলতে যা ছিল, তাতে বড় ধাক্কা লেগেছে। খবর রয়টার্স ও নিউইয়র্ক টাইমসের
আদানি গ্রুপের শেয়ারবাজার জালিয়াতি নিয়ে গত মঙ্গলবার এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চ। ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের পর আদানির কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমতে শুরু করে।
পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যে একজন ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন গৌতম আদানি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একই রাজ্য থেকে রাজনীতিতে উঠে এসেছেন। বিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, আদানি ও মোদির মধ্যে বহু বছর ধরে ব্যবসা ও রাজনীতি নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে।
স্বল্প সময়েই আদানির ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তার সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠে। তবে শুরু থেকেই একটি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্য ছিল আদানির। এ জন্য সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর থেকে শুরু করে একে একে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, খনি, ভোজ্যতেল, পুননবায়নযোগ্য জ্বালানি ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ করেন তিনি। সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সিমেন্ট খাতেও বিনিয়োগ করেছেন ভারতের সবচেয়ে ধনী এই ব্যক্তি।
আদানির ব্যবসা সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে তার সাতটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দামও হু হু করে বেড়েছে। বিশেষ করে সর্বশেষ তিন বছরে তার কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম দেড় হাজার শতাংশেরও বেশি বেড়েছে বলে বিভিন্ন খবরে বলা হচ্ছে। এ সময়ে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগও পেয়েছেন আদানি।
সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে ফোর্বসের তালিকায় বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি হয়ে যান আদানি। তার আগে ছিলেন বার্নার্ড আরনল্ট এবং ইলন মাস্ক। এ সময় তার মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৭ বিলিয়ন বা ১২ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০০ টাকা ধরে)।
এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও একটা সময় পর্যন্ত ৬০ বছর বয়সী আদানি অন্যান্য শতকোটিপতিদের তুলনায় অনেক কম পরিচিত ছিলেন। আদানি নিজেই সক্রিয়ভাবে তার সব কটি শাখার ব্যবসা পরিচালনা করেন। নিজের দুই ছেলে করণ ও জিৎকে এখন তিনি ব্যবসায় যুক্ত করেছেন। তার স্ত্রী প্রীতি আদানি দাঁতের চিকিৎসক।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ব্যবসায়িক সুবিধা পেয়েছেন—এমন অভিযোগবিরোধীরা তুললেও তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন আদানি।
২০১৪ সালে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আদানি বলেছিলেন, রাজনীতির সব পক্ষের সঙ্গেই তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে, তবে তিনি নিজে রাজনীতি এড়িয়ে চলেন। মোদি সরকারও আদানিকে সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।
মোদি আদানির করপোরেট বিমান ব্যবহার করার পর এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। তবে আদানি জানিয়েছিলেন যে মোদি ‘পুরো টাকা পরিশাধ করেন’।
সম্প্রতি আদানি তার ভাবমূর্তি গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করেছেন। এ জন্য তিনি দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। ভারতের অন্যতম শীর্ষ গণমাধ্যম এনডিটিভির বড় অংশের শেয়ার কিনে নেওয়াও তার এমন কার্যক্রমের অংশ বলে মনে করা হয়।
নিজেকে একজন লাজুক ব্যক্তি হিসেবে দাবি করা আদানি বলেছেন, তার জনপ্রিয়তার অন্যতম কৃতিত্ব বিরোধীদের। কারণ, তাদের ক্রমাগত সমালোচনার কারণেই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি।
‘মানুষজন আদানিকে চিনতে পেরেছে রাহুলজির জন্য; কারণ, তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং এরপর থেকে তাকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে আসছেন’, এ মাসের আরও আগের দিকে এক অনুষ্ঠানে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সম্পর্কে বলেছিলেন তিনি।
তিন সপ্তাহের মাথায় শুক্রবারে আদানির কোম্পানির শেয়ারে ধস নামে। শুধু চলতি সপ্তাহেই তার কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে ৪৮ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের মূলধন হারিয়েছে। হিনডেনবার্গ রিসার্চ বলছে, আদানির ব্যবসাগুলো বিশ্বের নানা জায়গায় দেয়া কর অবকাশ সুবিধার অনুচিত ব্যবহার করেছেন। একই সঙ্গে আদানির বিপুল ঋণের বিষয়েও যে উদ্বেগ রয়েছে, তা–ও তুলে ধরেছে ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ নামে যুক্তরাষ্ট্রের লগ্নি-সংক্রান্ত গবেষণাকারী এই প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকাশিত হওয়ার পরই আদানিদের শেয়ারের দাম হ্রাস পাচ্ছেই। মার্কিন সংস্থাটির দাবি, আদানি গোষ্ঠীর ঘাড়ে বিপুল পরিমাণে ঋণের বোঝা রয়েছে। এছাড়া অ্যাকাউন্টিংয়েও সমস্যা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে তারা। এর পাশাপাশি তারা দাবি করেছে, আদানি গ্রুপ ‘বহু বছর ধরেই অভাবনীয় স্টক ম্যানিপুলেশন এবং অ্যাকাউন্টিং জালিয়াতিতে জড়িত।’
হিনডেনবার্গ রিসার্চের গবেষণায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ গুজরাটি শিল্পগোষ্ঠী আদানিদের অস্বাভাবিক বাণিজ্যিক উত্থানের পেছনে জালিয়াতি ও শেয়ারবাজারে কারচুপিকে বড় করে দেখানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনের কারণে এই গোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারবাজারে ধস নামে। আদানিদের বিভিন্ন শেয়ারের দাম হু হু করে পড়ে যায়। বাজারে ছাড়া তাদের এফপিও (তালিকভুক্ত কোম্পানির বাজারে অধিকতর শেয়ার ছাড়া) ধুঁকতে থাকে। দুই দিনে বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় ৮০ হাজার কোটি রুপি। আদানি গোষ্ঠীতে লগ্নিকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারতীয় জীবনবিমা করপোরেশন (এলআইসি) ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বিপুল লোকসান হয়।
আদানি গ্রুপ অবশ্য এই রিপোর্ট ‘ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উল্লেখ করেছে। তবে হিন্ডেনবার্গ পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেছে। তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘রিপোর্ট যদি সত্যিই ভুল হয়, আদানি গ্রুপ আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করে আদালতে তা প্রমাণ করুক।’ আদানি গোষ্ঠী এরপরও হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট ভুয়া বলে জানিয়েছে। আর মার্কিন সংস্থাও তাদের অবস্থানে অনড়।
আদানির জন্য বিতর্ক অবশ্য নতুন কিছু নয়। কেরালায় তার ৯০ কোাটি ডলারের বন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে মৎস্যজীবীদের বিক্ষোভ হয়েছে, যার জন্য তিনি রাজ্য সরকার ও জেলে সম্প্রদায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় তার কারমাইকেল কয়লা খনির বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীরা দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন।
ভারতের ইমেজ গুরু হিসেবে পরিচিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পারফেক্ট রিলেশনসের সহপ্রতিষ্ঠাতা দিলীপ চেরিয়ান রয়টার্সকে বলেন, হিনডেনবার্গ রিপোর্টের প্রতিবেদন আদানির খ্যাতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তবে আদানি সেই ক্ষতি সীমিত করার জন্য পদক্ষেপ নিতে এবং বিনিয়োগকারীদের নানাভাবে আশ্বস্ত করতে পারেন।
তবে যে ধরনের উল্কাগতিতে আদানির উত্থান হয়েছে, তাতে তিনি যে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছেন, সে ব্যাপারে হয়তো খুব কম মানুষই দ্বিমত করবেন।
এসডব্লিউএসএস/১৮১০
আপনার মতামত জানানঃ