চীন এখন বিশ্বের একমাত্র একক বৃহৎ ঋণদাতা দেশ। প্রকাশ্য ঋণের অঙ্গীকার সত্ত্বেও চীনের অপ্রকাশিত বিপুল ঋণ রয়েছে বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইডড্যাটা বলছে, চীনা ঋণের একটি বড় অংশই প্রকাশ করা হয় না কিংবা পরিসংখ্যানে আসে না। কিছু বৈদেশিক ঋণ প্রায়ই চীনা সরকারি ব্যালান্সশিটে বরাবরই উহ্য থাকে। বিদেশী সরকারের সাথে চীনা সরকারের ঋণ দেওয়া-নেওয়ার পরিবর্তে চীন ঋণগুলো দেয় সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি, ব্যাংক, যৌথ অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে।
এইডড্যাটার তথ্যানুসারে, পৃথিবীতে ৪০টি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশ রয়েছে যেগুলোকে তাদের জিডিপির ১০ শতাংশ ঋণ দেওয়া হয়েছে ‘হিডেন ডেট’ হিসেবে। জিবুতি, জাম্বিয়া, রিপাবলিক অব কঙ্গো, নাইজার, লাওস, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনেগ্রো, কিরগিজিস্তানের মতো দেশগুলোকে তাদের জিডিপির ২৫ শতাংশের সমপরিমাণ ঋণ দিয়েছে চীন।
বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ঋণ বা অনুদান হিসেবে বাংলাদেশে অর্থায়ন শুরু করে চীন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পরিসংখ্যান বলছে, ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত ঢাকাকে ঋণ, অনুদান বা অর্থসহায়তা হিসেবে প্রায় ৩২১ কোটি ডলার দিয়েছে বেইজিং। এর মধ্যে ৯১ শতাংশের বেশি ছাড় হয়েছে গত নয় অর্থবছরে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক যোগাযোগ, দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ার কারণেই গত এক দশকে গতি পেয়েছে বাংলাদেশে চীনের অর্থায়ন কার্যক্রম।
এর মধ্যেই বড় পরীক্ষার মুখে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ। যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ঋণ পরিশোধ শুরুর এক বছরের মধ্যেই কিস্তি পরিশোধ নিয়ে বিপদে পড়েছে। ডলার সংকটে যোগ হয়েছে কাঁচামালের স্বল্পতা। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ হয়েছিল বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে মেগা প্রকল্প হিসেবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ দেশের বিভিন্ন খাতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বাস্তবায়নাধীন এমন আরো বেশকিছু মেগা প্রকল্পে এখন চীনের বিনিয়োগ রয়েছে। অর্থনীতির পর্যবেক্ষকদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, বাস্তবায়ন শেষে প্রকল্পগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে এ নিয়ে বড় ধরনের বিপত্তিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বেসরকারি উদ্যোগে নির্মীয়মান ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৪৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ১৭৬ কোটি ডলারের ঋণ অর্থায়ন হয়েছে চীনা উৎস থেকে। অর্থায়ন করছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ব্যাংক অব চায়না ও চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ছাড়াও সড়ক যোগাযোগ, রেলওয়ে ও সেতু নির্মাণ খাতের বড় প্রকল্পগুলোয়ও বিপুল পরিমাণ চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। এরই একটি পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। ইআরডি জানিয়েছে, প্রকল্পটিতে চীনা ঋণ প্রায় ২৬৭ কোটি ডলার। এ প্রকল্পে প্রধান অর্থায়নকারী চায়না এক্সিম ব্যাংক।
উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল। এটি নির্মাণে অর্থায়নের বড় অংশ এসেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে। ২০ বছর মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৭০ কোটি ডলারের বেশি।
ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রায় ১১৩ কোটি ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) আওতায় চীনা এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির ঋণের অর্থ পাঁচ বছরের রেয়াতকালসহ ২ শতাংশ সুদে ২০ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন খাতে ঋণ ও অনুদান হিসেবে মোট ১ হাজার ৭৭ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। এর মধ্যে প্রায় ৬৪৪ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। অনুদান হিসেবে এসেছে খুব সামান্য। সিংহভাগই ঋণ। এসব ঋণের সিংহভাগই এসেছে গত দুই দশকে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগের দুই বছরে দেশে বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ কোটি ডলারের বেশি অর্থায়ন করেছে সাতটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটিই ছিল চীনের। ওই দুই বছরে ব্যাংক অব চায়না, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না (চায়না এক্সিম ব্যাংক) ও চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক—এ তিন ব্যাংকের প্রতিটি বাংলাদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ৫৯ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এক্সিম ব্যাংক অব চায়না ঋণ দিয়েছে ৪৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার কাছ থেকে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে ৪০ কোটি ডলার।
ডলার ও জ্বালানি সংকটের বর্তমান পরিস্থিতি চলমান থাকলে ভবিষ্যতে বিদেশী ঋণ নিয়ে বিপত্তির মাত্রা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা। বিশেষ করে চীনা ব্যাংকগুলো থেকে গৃহীত ঋণ নিয়ে তাদের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো এসব ব্যাংক ঋণের ওপর সুদহার ধার্য করে অন্যান্য উৎসের চেয়ে অনেক বেশি। ঋণের বোঝা বাড়ানোর পাশাপাশি তা দেশের বৈদেশিক রিজার্ভেও বড় চাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
পায়রা কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে বিপত্তি। চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এনডব্লিউপিজিসিএল) যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা করছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দিয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক ও চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
পায়রা আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০২০ সালের মে মাসে। একই বছরের অক্টোবরে দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। গত বছর সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ হতে থাকলে পায়রার ওপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বৃহৎ কেন্দ্রটির বড় ভূমিকা রয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য কয়লা আমদানি হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের চেয়ে কয়লা তুলনামূলক সাশ্রয়ী। যদিও ডলার সংকট ও এলসি জটিলতায় এ সুযোগও এখন আর নিতে পারছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়লা আমদানির ঋণপত্র খুলতে দেরি করছে, যার কারণে কয়লা আমদানি করতে না পেরে কমছে কেন্দ্রটির মজুদ। বিসিপিসিএল কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে কয়লা সংকটের বিষয়টি বিদ্যুৎ বিভাগকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছে।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্লান্ট ম্যানেজার শাহ আবদুল মাওলা বণিক বার্তাকে বলেন, যে পরিমাণ কয়লার মজুদ আছে, তা দিয়ে দুই ইউনিট চালু করলে এ মাসের শেষ পর্যন্ত চলবে। কয়লার নতুন চালান না পেলে ফেব্রুয়ারিতে আমাদের দুটি ইউনিটই বন্ধ করে দিতে হবে।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন। বর্তমানে কেন্দ্রটির একটি ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) চালু রয়েছে। এজন্য প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টন কয়লার প্রয়োজন পড়ছে। আগামীকাল থেকে দ্বিতীয় ইউনিটটিও চালু করার কথা রয়েছে বলে বিদ্যুৎকেন্দ্র-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। সেক্ষেত্রে দৈনিক ১৩ হাজার টন কয়লার প্রয়োজন পড়বে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালু থাকলে মজুদ কয়লা দিয়ে জানুয়ারি শেষ করাও মুশকিল হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা মজুদ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও এনডব্লিউপিজিসিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএম খোরশেদুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পায়রায় ১৫-২০ দিনের কয়লা মজুদ রয়েছে। এলসি জটিলতা ও ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানি করতে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া আমাদের বকেয়া পাওনা ১৫১ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আজ (গতকাল) ৭৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ হয়েছে। বাকিটা বৃহস্পতিবার নাগাদ পাওয়ার কথা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সচল রাখার। নিয়মিত এলসি খোলা গেলে এবং বকেয়া পেলে হয়তো সেটি সম্ভব হবে।’
এসডব্লিউএসএস/১৮১০
আপনার মতামত জানানঃ