গত দুই বছরে বিশ্বে মোট যেসব সম্পদ অর্জিত হয়েছে তার দুই-তৃতীয়াংশের মালিক হয়েছেন মাত্র এক ভাগ মানুষ। বাকি ৯৯ ভাগ মানুষের হাতে এসেছে এক ভাগের অর্ধেক সম্পদ।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম ‘সারভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। সোমবার সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভায় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
অক্সফাম বলছে, ২০২০ সাল থেকে নতুন ৪২ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ গেছে বিশ্বের মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে। বিশ্বে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন কর্মী মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা যে দেশগুলোতে বসবাস করছেন সেখানে বেতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে চলেছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ প্রতিদিন দুই দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিলিয়নিয়ারদের অর্ধেক এমন দেশগুলোতে বাস করেন যেখানে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদের মালিক হতে কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না।
অক্সফাম বলছে, মিলিয়নিয়ার ও বিলিয়নিয়াররা পাঁচ শতাংশ হারে ট্যাক্স দিলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে বছরে এক দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলার। এই অর্থ দুই বিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করতে পারে।
অক্সফাম বলছে, ভারতের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ রয়েছে মাত্র এক ভাগ ধনীর হাতে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের মাত্র ১০ জন ধনী ব্যক্তির ওপর যদি ৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়, সেই টাকাতেই আগামী তিন বছর শিশুদের শিক্ষার ব্যায়ভার উঠে আসবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে ভারতের ধনকুবেররা যদি তাদের সম্পূর্ণ সম্পদের উপর একবার মাত্র ২% কর দেন তবে আগামী তিন বছরের জন্য ভারতে অপুষ্টির শিকার মানুষের পুষ্টির জন্য ৪০,৪২৩ কোটি টাকার প্রয়োজন মেটাবে। ২০২২ সালে ভারতে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬৬, যেখানে ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০২।
উপার্জনের পরিপ্রেক্ষিতে লিঙ্গ বৈষম্যেকেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। তফসিলি জাতি এবং গ্রামীণ কর্মীদের মধ্যে পুরুষ-মহিলাদের আয়ের পার্থক্য অনেকটাই বেশি। অক্সফ্যাম আরও বলেছে যে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভারতে ধনকুবেরদের সম্পদ প্রকৃত অর্থে ১২১ শতাংশ বা প্রতিদিন ৩৬০৮ কোটি টাকা বেড়েছে।
উল্লেখ্য, করোনা মহামারি কেবল মৃত্যু আর বিশৃঙ্খলাই বাড়ায়নি, এর কারণে বিশ্বজুড়ে বৈষম্যও বেড়েছে ব্যাপক। অক্সফামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির মধ্যে প্রতি ৩০ ঘণ্টায় নতুন করে একজন শতকোটিপতির (বিলিয়নিয়ার) জন্ম হয়েছে। বিপরীতে ১০ লাখ মানুষ হয়েছে দরিদ্র। খবর আল–জাজিরার।
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার্স ইনডেক্সের বরাত দিয়ে আল-জাজিরা জানিয়েছে, করোনা মহামারি চলাকালে বিশ্বের ১৩১ জন শতকোটিপতির সম্পদ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ২০২০ সালের শুরু থেকে গত ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি বার্নার্ড আর্নল্ডের সম্পদ বেড়েছে ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি।
দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্কের সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি। আর তৃতীয় শীর্ষ ধনী ভারতের গৌতম আদানির সম্পদ দশ গুণের বেশি বেড়েছে। ২০২০ সালের শুরুতে তাঁর সম্পদ ছিল প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
অন্যদিকে শুধু ২০২০ সালেই প্রায় ৯ কোটি ৭০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের কবলে পড়েছে। তাদের দৈনিক আয় ২ ডলারেরও কম। এ বছর শেষে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের হার ৯ ছাড়াবে বলে জানানো হয়েছে।
বিশ্বের প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ২০২০ সাল থেকে ১১ লাখ কোটি ডলারের (১১ ট্রিলিয়ন) বেশি বিনিয়োগ করেছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়ানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের ঋণ নেওয়া কমলেও বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে নতুন নতুন বিনিয়োগ করছেন।
পাশাপাশি মহামারি ও মন্দার মধ্যে অর্থনীতি চাঙা করতে অনেক দেশ অর্থের সরবরাহ বাড়ানো, কর সুবিধা ও আর্থিক প্রণোদনা দেয়। অক্সফামের এক জরিপে দেখা গেছে, কারোনাকালে বিশ্বের ১৬১টি দেশের মধ্যে ১৪৩টি দেশ ধনীদের জন্য কর সুবিধা বাড়িয়েছিল। এ ছাড়া আরও ১১টি দেশ করের হার কমিয়েছিল।
এসব কারণে ধনীদের সম্পদ বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও। শেয়ারবাজারের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসের তথ্যানুসারে, করোনার মধ্যে এক বছরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বেড়েছে ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার, যার মাত্র ৪০ শতাংশ ২৫টি কোম্পানির হাতে।
১৯৮০-এর দশক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের হিস্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাতে অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ে। মহামারি ও মন্দার মধ্যে এই ব্যবধান আরও বেড়ে যায়।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ইয়ানিস ডাফারমোস বলেন, যখনই অর্থনৈতিক সংকট আসে, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো উদারনীতি গ্রহণ করে। আর বড় কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ করে। এতে তাদের সম্পদ বেড়ে যায়। এর বিপরীতে দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষের দর–কষাকষির ক্ষমতা কমে যায়। ফলে বৈষম্য বাড়ে।
ডাফারমোস আরও বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়েও বড় কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমেনি; বরং মজুরি বাড়ানোর পরিবর্তে তারা শেয়ারধারীদের লভ্যাংশ দেওয়ার জন্য মুনাফা ধরে রাখছে। এমনকি কেউ কেউ কর্মীদের চাকরি থেকেও ছাঁটাই করছে।
অক্সফাম আমেরিকার ইকোনমিকস জাস্টিস বিভাগের পরিচালক নাবিল আহমেদ বলেন, ধনী-দরিদ্রের এই বৈষম্য অনিবার্য নয়। দেশে দেশে নীতিনির্ধারকদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই তা হয়।
এসডব্লিউএসএস/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ