বোস্টনের গবেষণাগারগুলোতে থাকা বৃদ্ধ, অন্ধ ইঁদুরেরা তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে; তাদের নতুন ও আরও বুদ্ধিসম্পন্ন মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে এবং আরও স্বাস্থ্যকর পেশি ও কিডনি টিস্যু তৈরি করেছে। অন্যদিকে, অল্প বয়স্ক ইঁদুর অকালেই বার্ধক্যে পৌঁছেছে, একইসঙ্গে তাদের শরীরের প্রায় প্রতিটি টিস্যুতে বিপর্যয় ঘটেছে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ব্লাভাটনিক ইনস্টিটিউটের জেনেটিক্সের অধ্যাপক এবং পল এফ গ্লেন সেন্টার ফর বায়োলজি অফ এজিং রিসার্চের সহ-পরিচালক, অ্যান্টি-এজিং বিশেষজ্ঞ ডেভিড সিনক্লেয়ার বলেন, পরীক্ষাগুলো দেখায় যে, বার্ধক্যকে উল্টোদিকে পরিচালিত করা সম্ভব, এবং এটিকে ইচ্ছানুযায়ী সামনের দিকে বা পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
আমাদের শরীর আমাদের যৌবনের একটি ব্যাকআপ কপি ধারণ করে যা পুনরায় কার্যকর হতে পারে বলে তাদের নতুন গবেষণাপত্রটিতে জানিয়েছেন সিনক্লেয়ার, যেখানে তার ল্যাবরেটরি এবং আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের কাজের প্রমাণ দেখানো হয়েছে।
সম্মিলিতভাবে করা পরীক্ষাগুলোর ফলাফল গত বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো সেল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বার্ধক্য হলো জেনেটিক মিউটেশনের ফল, যা আমাদের ডিএনএকে দুর্বল করে ফেলে, ক্ষতিগ্রস্ত কোষের টিস্যুগুলোর একটি ভাগাড় তৈরি করে, যার ফলে দেহের কার্যকরিতার অবনতি, রোগ এবং মৃত্যু হয়: বার্ধক্য নিয়ে এ বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এ ফলাফলগুলোতে।
সিনক্লেয়ার বলেন, এটি আবর্জনা নয়, এটি এমন ধরনের কোনো ক্ষতি নয় যা আমাদেরকে বুড়ো বানিয়ে ফেলে। আমাদের বিশ্বাস এটি তথ্যের হারিয়ে যাওয়া, মূল ডিএনএ পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কোষগুলো। ফলে এটি কীভাবে কাজ করবে তা ভুলে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা পুরোনো কম্পিউটারের সফটওয়্যার করাপ্ট হওয়ার মতো। আমি একে ‘ইনফরমেশন থিওরি অব এজিং’ নাম দিয়েছি।
সিনক্লেয়ার ল্যাবের জেনেটিক্স রিসার্চ ফেলো জায়ে-হিয়ুন ইয়াং গবেষণাপত্রটির সহলেখক ছিলেন। তিনি আশা করেন এ গবেষণার ফলাফল, “আমরা বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে যেভাবে দেখি এবং বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসা সারাতে আমরা যেভাবে চিন্তা করি, তা পরিবর্তন করবে।”
যদি ডিএনএকে শরীরের হার্ডওয়্যার হিসেবে দেখা হয়, তবে এপিজিনগুলো হলো সফটওয়্যার। ন্যাশনাল হিউম্যান জিনোম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, এপিজিন হলো প্রোটিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান, যা প্রতিটি জিনের ওপর দানার মতো বসে থাকে—জিনকে “কী করতে হবে, কোথায় করতে হবে এবং কখন করতে হবে” বলার অপেক্ষায় থাকে।
এ এপিজেন আক্ষরিক অর্থেই জিনকে চালু এবং বন্ধ করে। এই প্রক্রিয়াটি দূষণ, বিষাক্ত পদার্থ এবং ধূমপান বা ঘুমের দীর্ঘস্থায়ী অভাবের মতো মানবীয় আচরণের মাধ্যমে প্রভাবিত হতে পারে। আর ঠিক কম্পিউটারের মতো, বেশি পরিমাণ ডিএনএ ভেঙে গেলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই কোষীয় প্রক্রিয়াটি আর ভালোভাবে কাজ করতে পারে না, সিনক্লেয়ার ব্যাখ্যা করেন।
সিনক্লেয়ার বার্ধক্য প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “যেসব প্রোটিন জিনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলো ডিএনএ মেরামত করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সেগুলো যেখান থেকে শুরু করেছিল সেখানে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় না। সময়ের সাথে সাথে এ কোষীয় টুকরোগুলো তাদের পথ হারায়, অনেকটা আলঝেইমারে আক্রান্ত ব্যক্তির মতো।”
“আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, আমাদের প্রত্যেকের শরীরে এই সফটওয়্যারের একটি ব্যাকআপ কপি রয়েছে, যা আপনি পুনরায় ঠিক করতে (রিসেট) পারেন। আমরা দেখানোর চেষ্টা করছি কেন সফটওয়্যারটি নষ্ট হয়ে পড়ে (করাপ্ট) এবং কীভাবে আমরা একটি রিসেট বাটনে চাপ দিয়ে পুরো শরীরকেই রিস্টার্ট করে কোষের জিন সঠিকভাবে পড়ার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে পারি।”
সিনক্লেয়ার জানান, শরীরের বয়স ৫০ বা ৭৫, সুস্থ কিংবা রোগে আক্রান্ত কিনা, তা কোনো বিষয় নয়। একবার যদি এ প্রক্রিয়াটি কাজ শুরু করে, তখন “শরীরের মনে পড়বে কীভাবে তারা পুনরুত্থিত হবে এবং আবার তরুণ হবে। এমনকি যদি আপনি ইতোমধ্যেই বৃদ্ধ হন বা অসুস্থ হন, তবুও এটি কার্যকর হবে। তবে এই কোষীয় সফটওয়্যারটি কী, তা আমরা এখনও জানি না। এই মুহূর্তে আমরা কেবল জানি যে আমরা প্রক্রিয়াটি উল্টে দিতে পারি।”
প্রসঙ্গত, বার্ধক্য ঘুরিয়ে দেওয়ার এ সুইচের সন্ধান শুরু হয়েছিল অনেক আগে, সিনক্লেয়ার তখন একজন স্নাতক ছাত্র ছিলেন। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একদল গবেষক ইস্টের বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণের জিনের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। সিনক্লেয়ার অনুমান করেছিলেন, জিনটি যেহেতু সব প্রাণীতে আছে, তাই মানুষের মধ্যেও এই সুইচ থাকা উচিত।
তত্ত্বটি পরীক্ষা করার জন্য, তিনি মিউটেশন তথা ক্যান্সার সৃষ্টি না করেই ইঁদুরের বার্ধক্য দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিলেন।
সিনক্লেয়ার বলেন, “আমার যখন ৩৯ বছর বয়স, তখন আমরা সেই ইঁদুরটি নিয়ে কাজ শুরু করি। আমার বয়স এখন ৫৩, এবং আমরা সেই ইঁদুরটি নিয়েই এখনো গবেষণা করছি। যদি আমার ‘থিওরি অফ ইনফরমেশন এজিং’ তত্ত্বটি ভুল হতো, তাহলে আমরা হয় একট মৃত ইঁদুর, একটা সাধারণ ইঁদুর, একট বৃদ্ধ ইঁদুর অথবা ক্যান্সারে আক্রান্ত একটা ইঁদুর পেতাম। আমরা বৃদ্ধ ইঁদুরই পেয়েছি।”
অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাহায্য নিয়ে সিনক্লেয়ার এবং তার হার্ভার্ড গবেষণা দল ইঁদুরের মস্তিষ্ক, চোখ, পেশী, ত্বক এবং কিডনির টিস্যুর বয়স বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন।
এটি করার জন্য সিনক্লেয়ারের দল আইসিই তৈরি করেছে, যার পূর্ণরূপ ইনডিউসিবল চেঞ্জেস টু দ্য এপিজেনোম। ইঁদুরের ডিএনএর কোডিংয়ে পরিবর্তন করলে মিউটেশন হতে পারে। তাই, আইসিই ডিএনএ ভাঁজ করার উপায়কে পরিবর্তন করে। আইসিই রাসায়নিক, সূর্যালোকের মতো ক্ষতিকে অনুকরণ করে বার্ধক্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
সিনক্লেয়ারের গবেষণায় আইসিই প্রক্রিয়া ব্যবহার করা ইঁদুরগুলোর বয়স এক বছর হওয়ার পর তাদের শারীরিক আচরণ দুই বছরের ইঁদুরের মতো দেখাল।
এসডব্লিউএসএস/১০২৩
আপনার মতামত জানানঃ