বর্তমান দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিভীষিকাময় বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। শনিবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় আসকের কার্যালয়ে ২০২২ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নূর খান এ মন্তব্য করেন।
নূর খান বলেন, দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি বিভীষিকাময়। গণতন্ত্র সংকুচিত হলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। নির্বাচন কমিশন নিয়ে মানুষের আস্থা এখনও সঠিকভাবে আসেনি যে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেকটাই মাকাল ফলের মতো।
তিনি বলেন, গোপন যে ব্যবস্থা রয়েছে যাকে কারাগারে বা ডিটেনশন সেন্টার বলি কিংবা ইন্টারোগেশনের জন্য যে সমস্ত জায়গা রয়েছে সেগুলো বন্ধ করা উচিত। আমাদের আইন ও সংবিধান এগুলো সমর্থন করে না। যারা এগুলো পরিচালনা করেন তাদের চিহ্নিত করা উচিত।
নূর খান বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এখন কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। এই ভয়ের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “আমি কোন কথাটি বলব, বলার পরে আমার বা আমার সংগঠনের ওপর কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে, এই ভয় নিয়েই আমাদের কথা বলতে হয়। তাতে সেল্ফ সেন্সরশিপ চলে আসে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উপর খড়গ নেমে এসেছে। একটি সংস্থা অধিকারের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। এটা যে বার্তা দেয়, তাতে আমাদের কাজের পরিধি সংকুচিত হয়ে আসে।
“এককথায় বলতে গেলে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিভীষিকাময়। ভেতরের পরিস্থিতি অনেকটা এরকম যে আমাকে কম্বল জড়িয়ে আঘাত করা হচ্ছে, তাতে শরীর ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাইরে থেকে দৃশ্যমান হচ্ছে না।”
গুমের ঘটনাগুলো ‘সেভাবে’ প্রকাশ পাচ্ছে না মন্তব্য করে নূর খান বলেন, “এটা খুবই উদ্বেগজনক। একজন ব্যক্তিকে যে সময়ে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে এবং যে সময়ে তাকে ধরে আনার কথা বলছে পরিবার, এর মধ্যে আমরা বিস্তর ফারাক পাচ্ছি। আমাদের নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানে এরকম অনেকগুলো ঘটনা উঠে এসেছে যে, অনেককে তুলে নেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি, গ্রেপ্তারের বিষয়টিই অস্বীকার করা হয়েছে।
“এটি খুবই উদ্বেগজনক। বিশেষ করে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে আমরা দেখেছি যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষকে উঠিয়ে আনা হয়েছে। তাদের জঙ্গি তকমা দেওয়াও চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আদালতের মাধ্যমে তাদের একটা বড় অংশ কিন্তু ইতিমধ্যে ছাড়া পেয়েছে।”
আসকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, “তার মানে হচ্ছে জনগণের কিন্তু এখন পর্যন্ত জীবনের যে অধিকার সেগুলোর সবগুলোর ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যক্তিকে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে। পরবর্তীতে বলা হচ্ছে, গতকাল বা গত পরশু তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাদের কাছে এরকম অনেকগুলো তথ্য এসেছে যে, যেভাবে বলা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশিদিন তাদের আটক রাখা হয়েছে।”
আসকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, আমরা মনে করি, বিচারবহির্ভুত সকল তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। গুম, খুন ও অপহরণের ঘটনা বন্ধে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশন চিহ্নিত করবেন এ ধরনের তৎপরতার সঙ্গে কারা জড়িত আছেন।
জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আমরা বিচারবহির্ভূত প্রতিটি ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চাই। দেখেছি, প্রতিটি ঘটনার তদন্ত একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়। তাই প্রতিটি ঘটনার স্বাধীন তদন্ত হওয়া দরকার।
২০২২ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আসকের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংস্থাটির পরিচালক নিনা গোস্বামী ও সমন্বয়ক ফজলুল কবির। আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদায়ী বছরে সারা দেশে ৪৭৯টি রাজনৈতিক সংহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭০ জন। আহত হন ৬ হাজার ৯১৪ জন। এ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৯ জন। শুধুমাত্র র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৪ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আরো ১৫ জন নিহত হয়েছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগে মামলা হয়েছে ২২৪৯টি। অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ হয়েছেন ৫ জন। নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৯৪টি। খুন হয়েছে ১২৬ জন নারী। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ জন। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১২ জন নারী। শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪৫টি। এ ধরনের ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪৭৪ শিশু।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিদায়ী বছর সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন ২১ জন। গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৩৬ জন। কারা হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের। এছাড়া ২০২২ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর ১২টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২১০ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে আসকের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ