বিশ্বে প্রতি বছর ৫ বছরের নীচে ৭ লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১৮ হাজার ৫ বছরের নিচে শিশু নিউমোনিয়ার মারা গেছে। এর পরের হিসাব জানা নেই সংশ্লিষ্টদের। যদিও সরকারের গালভরা উন্নয়নের গল্পে সাধারণ মানুষের এমন অজস্র ভোগান্তি চাপা পড়ে যায়। দেশে পদ্মাসেতু হয়। মেট্রোরেল হয়। শুধু শিশুরা আইসিইউ-এর অভাবে ধুঁকতে থাকে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আইসিইউ ও সিসিইউ-এর জন্য গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন শিশু অপেক্ষমাণ থাকে। এখানে অবস্থানরত শিশুদের অধিকাংশই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসে, তাদের আর্থিক অবস্থা এতটা স্বচ্ছল নয় যে তারা বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সেবা নিতে পারে।
বিজ্ঞজনেরা বলেন, দেশে সরকারিভাবে শিশুদের আইসিইউ ও সিসিইউ শয্যার চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। তাই প্রতিবছর এক বছরের নিচে ৪৮ শতাংশ শিশু নিউমোনিয়ায় হাসপাতালে মারা যায়।
উল্লেখ্য, ছয় দিনের ভাইয়ের মেয়েকে নিয়ে দুই দিন ধরে ঢাকা শিশু হাসপাতালের এইচডি আইসোলেশনে চিকিৎসা করাচ্ছেন ফুপু নূরজাহান। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা নিয়ে জন্ম নেওয়া এই শিশুর প্রয়োজন আইসিইউ। চিকিৎসকরা বলছেন, তার নিউমোনিয়া হয়েছে। তাকে অতিসত্বর আইসিইউতে নিতে হবে। কিন্তু আইসিইউতে জায়গা না থাকায় তাকে দেওয়া যাচ্ছে না সেখানে। শুধু তাই নয়,
হাসপাতালের অবস্থা
শিশু হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি সিটই ঠাণ্ডাজনিত রোগীতে পূর্ণ। কর্তব্যরত নার্স প্রতিভা রিবেরু জানান, গতরাতে তিনজন রোগী ভর্তি হয়েছে এই ওয়ার্ডে-এদের মধ্যে দুই জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ৩৯ নম্বর বেডের রোগী পটুয়াখালী থেকে এসেছে। ছয়মাস বয়সের এই শিশুর কয়েকদিন যাবত জ্বর ছিলো। গত দুই দিন ধরে শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। স্থানীয় হাসপাতালে তিনদিন চিকিৎসা করিয়ে তারা এখানে আসেন। তাকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। ২ দিনের এই শিশুকে নিয়ে আসেন চাচা হৃদয় ও চাচী মুন্নি।
হৃদয় জানান, জন্মের পর থেকেই শিশুর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা থাকায় চিকিৎসকরা তাকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলেন। তাকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। অনবরত কাঁদছে শিশুটি। এইচডি আইসোলেশনের ইনচার্জ মুনা আক্তার জানান, এখানে কয়েকজন শিশুরই আইসিইউ সেবা প্রয়োজন।
কিন্তু সিট খালি না থাকায় তাদের সিপ-আপ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের আসলে কিছু করার নেই। কেউ মারা গেলে কিংবা সুস্থ হলেই আর একজনের জায়গা হবে। আমরা তাদের ওপরওয়ালাকে ডাকতে বলি। যেন কোন আশ্চর্য ঘটনা বলে তারা বেঁচে যায়।
পরিসংখ্যান
বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে শিশুদের জন্য অত্যন্ত জটিল সমস্যা নিউমোনিয়া। দেশে প্রতি হাজারে ৩৬১ জন শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। আর পাঁচ বছরের কম বয়সে মারা যাওয়া শিশুদের প্রতি পাঁচজনে একজন নিউমোনিয়া বা ফুসফুসের সংক্রমণজনিত কারণে মারা যায়, যা দেশে মোট শিশু মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এছাড়া জন্মের পাঁচ বছর শেষ হওয়ার আগেই প্রতি হাজারে আটজন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এমনকি প্রতিরোধযোগ্য রোগটিতে বছরে ২৫ হাজার হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৬৮ জন শিশু মারা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, অক্টোবর মাস থেকেই শিশু নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে বলে জানান হাসপাতালের ইপিডেমিওলজিষ্ট (দায়িত্বপ্রাপ্ত) ডা. এ বিএম মাহফুজ হাসান আল মামুন।
গত অক্টোবরে ৩২০ জন নিউমোনিয়া শিশু ভর্তি হয়। নভেম্বরে ৩০৮ জন রোগী পাওয়া যায়। গত নভেম্বর মাসে শিশু হাসপাতালে ১৫৩ জন রোগী মারা যায়। যার মধ্যে ৪৫ জন নিউমোনিয়ায় মারা যায়, যার ৪০ জনই এক বছরের নিচে।
গতবছর ২ হাজার ২২৭ জন নিউমোনিয়া রোগী শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়। ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা হয় ২ হাজার ৮৫৪ জন। করোনাকালে নিউমোনিয়ার আক্রান্তের সংখ্যা কম ছিল বলে জানান চিকিৎসকরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামত
উপজেলা থেকে সময় মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের পাঠানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেক জায়গায় ভ্যান্টিলেশন ব্যবস্থা নাই। তাই গুরুতর রোগীকে সময়মতো কেন্দ্রীয় হাসপাতালে পাঠানো জরুরি।
তারা জানান, ৪৮ শতাংশ রোগী হাসপাতালে, ৪৪ শতাংশ রোগী বাড়িতে এবং ৮ শতাংশ রোগী রাস্তায় মারা যায়। নিউমোনিয়া থেকে বাঁচার জন্য শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ওপর জোর দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। শিশুদের মাঠে খেলাধুলা করা, রোদের ভিটামিন-ডি দিতে হবে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, সুষম খাদ্যের সঠিক বণ্টন শরীরে থাকতে হবে। তা হল ৫০ শতাংশ শর্করা, ৩০ শতাংশ আমিষ এবং ২০ শতাংশ চর্বির সঙ্গে পানি ও ভিটামিন খেতে হবে।
শিশুদের এমন কোন পোশাক পরানো যাবে না যাতে সে ঘেমে যায় এবং ঘাম শুকায় না। তাপমাত্রার সঙ্গে মানানসই পোশাক পরাতে হবে। শিশুদের শরীরে ইয়েলো ভ্যাট থাকে, যা শরীর গরম করে। তাই তাদের গরম বেশি শীত কম। আলো-বাতাসময় পরিবেশে বাস করতে হবে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। শিশুদের বিয়ে শাদী, শপিংমল, বাজার ও জনসমাগম হয় এমন স্থানে কম নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, করেনাকালে শিশুরা ঘরে ছিল বলেই আমাদের নিউমোনিয়া রোগী কম ছিল। দিন দিন অনেক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া পৃথিবীতে আসছে-এদের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এসডব্লিউএসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ