পথচারী ও বাসযাত্রীর থামিয়ে মোবাইল ফোন তল্লাশির অভিযোগ উঠেছে পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে। বিএনপির ঢাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন আগে থেকেই পুলিশের পাহারা এবং তল্লাশি শুরু হয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় আসা অনেক নেতা-কর্মী অভিযোগ করেছেন যে, পুলিশের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও তাদের তল্লাশি করেছেন।
এই সময় তাদের মোবাইল ফোন খুলে ফটোগ্যালারি তল্লাশি করা হয়েছে বলে অনেক নেতা-কর্মী অভিযোগ করেছেন। কিন্তু চাইলেই কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা কোন ব্যক্তি অন্য আরেকজনের মোবাইলের ফোনের মতো ব্যক্তিগত জিনিসে তল্লাশি করতে পারে? বাংলাদেশের আইন কী বলে? এসব ক্ষেত্রে প্রতিকারের কী উপায় রয়েছে?
মোবাইলের ফোন তল্লাশি
রাজবাড়ী থেকে বিএনপির সমাবেশে এসেছিলেন মোহাম্মদ বাবুল। তিনি জানান, গাবতলীতে পুলিশ থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবো, কেন ঢাকায় এসেছি। বললাম আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবো। তখন বলে মোবাইল বের করে ছবিগুলো দেখাও। সেখানে কিছু না পেয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
তিনি জানান, পুলিশ মোবাইল চেক করছে জানতে পেরে ঢাকায় আসার আগেই গ্যালারি থেকে দলের ছবি বা ভিডিও ডিলিট করে দিয়েছিলেন।
বিএনপির একাধিক নেতা-কর্মী অভিযোগ করেছেন, এভাবে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তারা পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের তল্লাশির শিকার হয়েছেন।
গাজীপুর থেকে ব্যবসায়িক কাজে শুক্রবার বিকালে ঢাকায় ফিরছিলেন মনসুর আহমেদ। তিনি বলছেন, আমি কোন সমাবেশে যাচ্ছিলাম না। ব্যবসার কাজে প্রায়ই গাজীপুরে আসতে হয়। কিন্তু শুক্রবার পথে তিন জায়গায় পুলিশ থামিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। দুই জায়গায় মোবাইল ফোন বের করে ছবি, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছে। এর আগে এমন কখনো হয়নি।
মানবাধিকার সংস্থার নিন্দা
পুলিশের এরকম তল্লাশি ও মোবাইল ফোন চেক করার ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
রবিবার একটি বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, ‘’গোপনীয়তা একজন ব্যক্তির সংবিধান স্বীকৃত অন্যতম একটি মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৩ এ এই অধিকারটি নিশ্চিত করা হয়েছে।‘’
‘মুঠোফোনে মানুষের ব্যক্তিগত ও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, তথ্য বা ছবি থাকতে পারে, যা ঘাঁটাঘাঁটি করা একজন ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকারের চরম লঙ্ঘন। এছাড়াও একজন ব্যক্তির গোপনীয়তার সাথে তার মর্যাদার সম্পর্ক জড়িত।’
পুলিশের বক্তব্য
তল্লাশির নামে হয়রানি প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেছেন, “অপরাধীদের ধরতে পুলিশ বিশেষ চালাচ্ছে। তল্লাশির সময় মোবাইল ফোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে নিরাপত্তার স্বার্থেই। তবে পুলিশের কোন সদস্য অহেতুক কাউকে হয়রানি করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মনজুর রহমান বলেছেন, ‘নিয়মিত কাজের অংশ হিসাবেই পুলিশ তল্লাশি বা চেকপোস্ট বসিয়ে থাকে। কাউকে সন্দেহ হলে তল্লাশি বা জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে। সেখানেও পুলিশ যা কিছু করেছে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই করেছে।’
অভিযোগ ও ছাত্রলীগের বক্তব্য
ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় পথচারীদের মোবাইল ফোন তল্লাশির অভিযোগ তুলে একাধিক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন, কারও মোবাইলে বিএনপি সংশ্লিষ্ট ছবি বা তথ্য পেলে তাকে মারধর বা পুলিশে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন একজন ভুক্তভোগীর একটি স্ট্যাটাস শেয়ার করে অভিযোগ করেছেন, নীলক্ষেত এলাকা থেকে আসার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিছু ছেলে একজনের মোবাইল, ব্যাগ মানিব্যাগ চেক করে কিছু না পেয়ে জোর করে বিকাশের পিন নিয়ে ১৮ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। এজন্য তিনি ছাত্রলীগের কর্মীদের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মীরা একটি সাংগঠনিক নির্দেশনা ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতির কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছি। দশই ডিসেম্বর বিএনপি জামায়াতের নাশকতা আগুন সন্ত্রাসের চেষ্টা, বোমাবাজির চেষ্টা প্রতিহত করার জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শুধুমাত্র রাজনৈতিক অবস্থান, মিছিল মিটিং এবং রাজু ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, অন্য কোন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ন্যূনতম কোন সম্পর্ক নেই।’
পুলিশ চাইলেই কি মোবাইল তল্লাশি করতে পারে?
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘মোবাইল ফোন পুরোপুরি একজনের ব্যক্তিগত একটি যন্ত্র। আদালতের আদেশ ছাড়া কোনভাবেই সেটা সার্চ করার এখতিয়ার কারও নেই। কারণ এই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার তাকে বাংলাদেশের সংবিধানে দেয়া হয়েছে।’
তিনি জানান, তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে বহুদিন যাবৎ ব্রিটিশ আমলের আইন অনুসরণ করে করা হলেও ২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিনা পরোয়ানায় (৫৪ ও ১৬৭ ধারায়) গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের ক্ষেত্রে ১৫টি নির্দেশনা জারি করেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের এপ্রিলে কিছু সংশোধন সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট সেই আদেশ বহাল রাখেন।
সেখানে বলা হয়েছে, কোন পুলিশ কর্মকর্তা সন্দেহের বশে কাউকে তল্লাশি করা দরকার মনে করলে সেটা ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করে সাক্ষীর উপস্থিতিতে করবেন। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র দেহ তল্লাশির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন, ‘মোবাইল হচ্ছে খুব পার্সোনাল একটি গ্যাজেট, যেটা মালিকের পারমিশন ছাড়া ধরার কারও আইনগত এখতিয়ার নেই। যদি কোন মামলার অংশ হিসাবে মোবাইল ফোন আদালতে উপস্থাপন করা হয়, তখন আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তকারী ব্যক্তিরা সেটা দেখতে পারবে। এছাড়া আর কোন সুযোগ নেই। ’
‘আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, সেটার গুরুতর লঙ্ঘন। একপ্রকার ফৌজদারি অপরাধের মধ্যেও পড়ে।’
আইনজীবীরা বলছেন, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোবাইল ফোন দেখতে চাইলে যেকোনো নাগরিক তাতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। কারণ আইন অনুযায়ী, আদালতের নির্দেশ ছাড়া তারা সেটা করতে পারেন না। তবে তিনি এও স্বীকার করেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এরকম কোন উদাহরণ নেই।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন, ‘যেহেতু এটা একপ্রকার হয়রানি, সেজন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। অথবা তিনি ফৌজদারি মামলাও করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে আসলে এরকম প্র্যাকটিস নেই।’
এসডব্লিউএসএস/১৮৩৭
আপনার মতামত জানানঃ