সৌদি আরব ও চীন এক গুচ্ছ কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সম্পর্ক আরও গভীর করে তোলার ছবি স্পষ্ট করেছে। সৌদি আরবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের মধ্যে বহস্পতিবার এসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
সৌদির বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একটি ‘ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে’ স্বাক্ষর করেন।
এসব চুক্তির মধ্যে বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ের সঙ্গে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিও আছে। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে হুয়াওয়ের বাড়তে থাকা প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়িয়েছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে।
চীন ও সৌদির সংস্থাগুলো জলবায়ুবান্ধব জ্বালানি (গ্রিন এনার্জি), তথ্য প্রযুক্তি, ক্লাউড সেবা, পরিবহন, নির্মাণ ও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের ৩৪টি চুক্তি স্বাক্ষর করে বলে জানিয়েছে সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা এসপিএ।
এসপিএ-র প্রতিবেদনে বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখ করা না হলেও এর আগে তারা জানিয়েছিল, শি জিনপিংয়ের সফরে প্রাথমিকভাবে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে।
পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে নতুন বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব জোরদারে তৎপর সৌদি আরব চীনের প্রেসিডেন্টকে বুধবার রাজকীয় অভ্যর্থনা জানিয়েছে। এ দিনই মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ প্রভাবশালী দেশটিতে তিন দিনের সফরে আসেন শি।
শি জিনপিংয়ের গাড়িকে সৌদি রাজকীয় রক্ষী বাহিনীর অশ্বারোহী সদস্যরা পাহারা দিয়ে রিয়াদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে যায়, তাদের হাতে ছিল চীন ও সৌদি আরবের জাতীয় পতাকা। রাজপ্রাসাদে সৌদি আরবের ‘প্রকৃত শাসক’ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান হাসিমুখে শি-কে অভ্যর্থনা জানান। পরে শি একটি রাজকীয় ভোজে যোগ দেন।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সাত বছর পর সৌদি আরব সফরে গেলে তাকে নিয়ে আরব বিশ্বের নেতাদের মধ্যে যে মাত্রার যে আগ্রহ-উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তার নজির বিরল। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারসহ উপসাগরীয় সহযোগিতা জোট জিসিসির সবগুলো দেশের নেতারা প্রেসিডেন্ট শির সাথে বৈঠকের জন্য রিয়াদে আসেন।
পরে, শুক্রবার একটি চীন-আরব শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিতে রিয়াদে হাজির হন মিশর, তিউনিসিয়া, লেবানন, ইরাক এবং সুদানের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। আরব বিশ্বের নৈকট্যের জন্য চীনারাও তাদের আগ্রহ-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি।
সৌদি আরবের গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে শি বলেছেন, তিনি ‘আরব বিশ্ব, উপসাগরীয় আরব দেশগুলো এবং সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের একটি নতুন যুগ শুরু করতে’ একটি ‘সূচনা সফরে’ সেখানে গিয়েছেন।
চীন ও আরব দেশগুলো ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি উচ্চে তুলে ধরে রাখবে’ বলে যোগ করেন শি জিনপিং।
এদিকে, সৌদি সরকারের ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়নে চীনকে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে দেখছেন যুবরাজ সালমান। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার ও বিভিন্ন মেগা প্রকল্পগুলোতে চীনা কোম্পানির সম্পৃক্ততা বাড়াতে চাইছেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ এসব মেগা প্রকল্পের মধ্যে আছে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের ‘ফিউচারিস্টিক’ মেগাসিটি। প্রযুক্তিনির্ভর শহরটিতে ঢুকতে হলে মুখ শনাক্ত ও নজরদারির প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
আমেরিকার জন্য সতর্কবার্তা
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন বেশ কিছুদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে সৌদি আরব বা ইউএইর মধ্যে, নিরাপত্তা, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্য আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর তাগিদ দেখা যাচ্ছে।
দুই হাজার সতের সালে সৌদি আরবের ক্ষমতা হাতে পাবার পর যুবরাজ সালমান আধুনিক এবং স্বাবলম্বী একটি দেশে পরিণত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।
এজন্য গুপ্তচরবৃত্তিতে সংশ্লিষ্টতার যুক্তিতে চীনা যে টেলিকম কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্র নিষিদ্ধ করেছে সেই হুয়াওয়ে সৌদি আরব এবং ইউএই সহ বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক বসিয়েছে। স্পর্শকাতর তথ্য চুরির ঝুঁকি নিয়ে আমেরিকার কথা এসব দেশ কান দেয়নি।
এমনকি বুধবার সৌদি আরব ও চীনের মধ্যে যেসব চুক্তি হয়েছে তার মধ্যে একটি চুক্তির আওতায় হুয়াওয়ে সৌদি আরবে বেশ কতগুলো ডেটা সেন্টার প্রতিষ্ঠিত করবে যেখানে ক্লাউডে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ডেটা সংরক্ষিত থাকবে।
তবে আমেরিকার সাথে সৌদি প্রশাসনের সম্পর্ক শীতল হওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ সাংবাদিক জামাল খাসোগজির হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যুবরাজ সালমানের সাথে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সম্পর্কের টানাপড়েন ।
ঐ হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই খোলাখুলি যুবরাজ সালমানকে দায়ী করে অনেক বক্তব্য দিয়েছেন। তাকে একঘরে করে ফেলার হুমকি দিয়েছেন।
খাসোগজি হত্যাকাণ্ডের জন্য যেন যুবরাজ সালমানকে কখনো যুক্তরাষ্ট্রে মামলায় না পড়তে হয় তার নিশ্চয়তা চেয়ে সৌদি রাজপ্রসাদের পক্ষ থেকে হোয়াইট হাউজের কাছে অনুরোধ করা হলেও এখনও কোনো নিশ্চয়তা বাইডেন দেননি।
যুবরাজ সালমান অপমানিত বোধ করছেন। শি জিনপিংকে নিয়ে তিনি যে মাতামাতি করলেন তার পেছনে আমেরিকাকে দেখানোর বিষয়টিও রয়েছে বলে নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে।
বাইডেন যখন জেদ্দায় আসেন তাদের দুজনের মধ্যে করমর্দন পর্যন্ত হয়নি। এখন মোহামেদ সালমান শিকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে আমেরিকানদের দেখাতে চেয়েছেন তিনি নতুন এক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পথ নিয়েছেন। শুধু তিনি নিজে নয় অন্যান্য আরব নেতাদেরও তিনি এই পথে আনছেন।
“গত তিনদিনে রিয়াদে যে আড়ম্বর হলো তার প্রতীকী মূল্য অনেক। মোহামেদ সালমান আমেরিকানদের বলতে চেয়েছেন আমাকে তোমরা একঘরে করে দেবে বলেছিলে। এখন দেখ তা হয়নি।”
এসডব্লিউএসএস/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ