শেখ হাসিনা বলেছেন, তার দল নির্বাচনে ‘ভোট চুরির’ সাথে জড়িত নয়। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি তাদের ‘নমিনেশন বাণিজ্যের’ কারণে নির্বাচনে জিততে না পেরে আওয়ামী লীগের উপর উপর দায় চাপিয়েছে।
“আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়। আমরা ভোট চুরি করতে যাব কেন? জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের ভোট দেয়।”- মঙ্গলবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ছাত্রলীগের সম্মেলনে বক্তৃতার সময় শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
দুই হাজার আঠারো সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ এনে শেখ হাসিনা বলেন, “বিএনপি জিতবে কীভাবে? এক সিটে যদি তিনজন করে নমিনেশন দেয়, ফখরুল একজনকে নমিনেশন দেয়, রিজভী আরেকজনকে দেয় আর লন্ডনে থেকে তারেক দেয় আরেকজনকে।”
“যে যত টাকা পায় সে ততটা নমিনেশন দেয়। সেখানে হলো টাকার খেলা। তারপর নির্বাচন থেকে শেষে সরে দাঁড়িয়ে বলে আমাদের নির্বাচন করতে দিল না।”
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ভোট চুরি, ভোট কারচুপি; এই কালচার কে দিয়েছে? জিয়াউর রহমান। হ্যাঁ-না ভোট দিয়ে জনগণের ভোট ছিনিয়ে নিয়েছেন। ‘না’র ব্যালট পাওয়া যায়নি। সব ‘হ্যাঁ’ ভোটই ছিলো।
শেখ হাসিনা বলেন, ভোট চুরি করলে মানুষ ছেড়ে দেয় না এটা খালেদা জিয়ার মনে থাকা উচিত। তিনি বলেন, অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষও জিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কথা বলেছিলেন। এখনো অনেকে আছেন খালেদা জিয়া-তারেক জিয়ার সঙ্গে। মানিলন্ডারিং, অস্ত্রকারবারি ও ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার আসামি তারেক। খালেদা এতিমের টাকার আত্মসাতের মামলার আসামি। এই অপরাধীদের সঙ্গে এখন অনেক জ্ঞানীগুণীও গণতন্ত্রের কথা বলেন। তারা বুদ্ধিজীবী না, তারা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীজীবী।
বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়ার পেটুয়াবাহিনী সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। ঢাবিতে রাতের অন্ধকারে ভিসিকে সরিয়ে নতুন আরেকজনকে বসিয়ে ভিসির পদটাও দখল করে নেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শিক্ষকসহ বহু নেতাকর্মী হত্যা করে।
তাদের অত্যাচারে বাংলাদেশ ছিল নির্যাতিত। শুধু ক্ষমতায় থাকলেই না, ক্ষমতার বাইরে থেকেও অগ্নিসন্ত্রাসের কথা সবার জানা। ২০১৩-১৪ সালে প্রায় তিন হাজার মানুষকে দগ্ধ করেছে তারা। বাস, লঞ্চ ও রেল কোনো কিছুই তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে শিক্ষা দিতে ছাত্রদলই যথেষ্ট। এর প্রতিবাদে আমি ছাত্রলীগের হাতে বই-খাতা কলম তুলে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম শিক্ষা শুধু নিজেরাই গ্রহণ করবে না, গ্রামে গিয়ে নিরক্ষর মানুষকে শিক্ষা দেবে। তারা সেটিই করেছি।
এর আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিজে সংগ্রাম করেছেন এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ শাসনামলেই হয়েছে।
প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে শ্রদ্ধা জানাতে যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে আগামী সাধারণ নির্বাচন নিয়ে তার সরকারের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে করা বিবিসির সাংবাদিক লরা কুনেসবার্গের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রতিষ্ঠার জন্যই আমার সংগ্রাম।…শুধু আওয়ামী লীগের আমলেই আপনারা অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে পাবেন।”
প্রকৃত বাস্তবতা
২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই তিনটি নির্বাচনের মধ্যে কেবল ২০০৮ সালের নির্বাচনটিই ব্যাপকভাবে সমাদৃত। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন কেন দেশে-বিদেশে এতবেশি সমালোচিত? এর সম্ভাব্য উত্তর, নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া।
সংবিধান অনুযায়ী ২০২৩ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অধীনে ফের নির্বাচন হবে। তাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো এবারের নির্বাচনও কী বিতর্কিত হতে চলেছে? বিতর্কমুক্ত থাকতে বছরের শুরুতে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন পাস করে ক্ষমতাসীন সরকার। বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে এটি একটি অলৌকিক ঘটনা।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের হিসাব দেখলে দেখা যাবে, মোট ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৭ টিতে জিততে দেয়া হয়েছিল বিরোধী দলকে। এদিকে, আগামী ২০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর এই নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এই নির্বাচনকে কতখানি সুষ্ঠু ও স্বাধীন হতে দেবে এবং এতে জনগণের ইচ্ছা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে কিনা।
গত ১৩ বছর ধরে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে; ২০০৮, ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে। ২০০৬ ও ২০০৭ এই দুই বছর সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার পর ২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আর সেই নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এবং ২০০৮ সালের সেই নির্বাচনই সর্বশেষ স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃত। অর্থাৎ এরপরের দুইটি নির্বাচন পাতানো বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মাথায়, ২০১১ সালে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে অপসারণ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর প্রতিবাদ স্বরূপ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বে ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট বা বর্জন করে বিরোধীদলগুলো। সেসময় তারা বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। কিন্তু তাদের বয়কটের সিদ্ধান্তকে আমলে না নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
মাহবুব তালুকদারের স্বীকারোক্তি
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। ওই নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর অস্তিত্ব ছিল না। যদিও সিইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে দাবি করেন। জেলা প্রশাসকেরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিটিং এমপিদের বিষয়ে তাদের নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল বলে মনে করি না। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এতেই বোঝা যায় নির্বাচন কেমন হয়েছে? এভাবে না অবাধ, না সুষ্ঠু, না নিরপেক্ষ, না আইনানুগ, না গ্রহণযোগ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন নিয়ে এমনই মন্তব্য করেছিলেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপার ভর্তি বাক্সের ছবি বিবিসির সাংবাদিক প্রকাশ করেন। এই অভিযোগ প্রসঙ্গে মাহবুব তালুকদার বলেন, এই অভিযোগ খণ্ডনের কোনো উপায় ছিল না। কারণ, এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। আদালতের নির্দেশ ছাড়া রাতের ভোটের তদন্ত করা যেত না, তা ঠিক নয়। নির্বাচন যথাযথ হয়নি মনে করলে কমিশন ফলাফল ঘোষণার পরও নির্বাচন বাতিল করতে পারে।
জাতীয় নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। নির্বাচনের পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে সিইসি বলেছিলেন,─‘এই নির্বাচনের বিষয়ে আমি অতৃপ্ত নই, তৃপ্ত। শুধু আমি নই, পুরো কমিশনই সন্তুষ্ট। কেউ তো আমাকে তাঁর অসন্তুষ্টির কথা বলেননি।’ এমনকি তিনি জানান, সংসদ নির্বাচনের আগে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসির নিয়ন্ত্রণে ছিল না।
এসডব্লিউএসএস/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ