বর্তমানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেইঞ্জে মোট ২২১টি তালিকাভুক্ত ট্রেজারি বন্ড রয়েছে। তালিকাভুক্ত থাকলেও এসব বন্ডের লেনদেন হয় না এবং লেনদেনের কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি সরকার। ফলে বন্ড বাজারটি শুধু রয়ে গেছে নীতি নির্ধারকদের প্রতিশ্রুতি আর মুখের বুলিতে। এদিকে ‘সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’-এর অর্থসংস্থানের জন্য সরকার ইসলামী বন্ড ‘সুকুক’ নিলামে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এতে আড়ালে থেকে যাচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেইঞ্জের তালিকাভুক্ত অন্যান্য বন্ড।
জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু গত অর্থবছর শেষে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকার। যেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৭১ দশমিক ১০ শতাংশ। এটি গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রির কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণ কিছুটা বেড়েছে। এজন্য ব্যাংক নির্ভরতা কমাতে সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। যাতে করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সহজে সরকারী সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে পারেন। এতে করে ব্যাংকগুলোর ওপর সরকারের ঋণের চাপ কিছুটা কমবে।
গত অর্থবছর শেষে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকার। যেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৭১ দশমিক ১০ শতাংশ।
এক গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোর উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে বড় অংকের অর্থ আসে বন্ড থেকে। অর্থনীতির বিপর্যয় ঠেকাতে করোনা মহামারীতেও বন্ড বিক্রি কার্যক্রম বাড়িয়েছে ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। অথচ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই তলানিতে। মূলত নীতিমালার অভাবে দেশে এখনও বন্ড মার্কেট তেমন সচল হয়নি, সীমিত আকারে বাজারে চালু রয়েছে। এগুলো লেনদেন হয় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। সাধারণের হাতে বন্ড আসার সুযোগ নেই। ইস্যুকৃত অধিকাংশ বন্ড ব্যাংক কর্তৃক ক্রয় ও ধারণ করা হয়। কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতেও কিছু বন্ড রয়েছে। মূলত এরাই বাংলাদেশের বন্ড বাজারের প্রধান ক্রেতা।
বন্ড মার্কেট নিয়ে দেশে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। আর এ কারণে বন্ড মার্কেট বড় হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, কোম্পানিগুলো মূলধন সংগ্রহে ব্যাংক ঋণের ওপর অতি বেশি নির্ভরতার কারণে এই বাজার বড় হয়নি। তবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নে বন্ড মার্কেটের বিকল্প আর কিছুই নেই।
এবিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মিনা জানান, বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থেই কোন বন্ড মার্কেট সেভাবে গড়ে ওঠেনি। যেসব পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে তারা কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। তবে এই ঋণের প্রয়োজন হতো না, যদি একই সঙ্গে বন্ড ইস্যু করার কথা বলা হতো।
বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থেই কোন বন্ড মার্কেট সেভাবে গড়ে ওঠেনি। যেসব পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে তারা কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে।
এদিকে দেশে অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে অর্থসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য সরকার ইসলামী বন্ড ‘সুকুক’ নিলামে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাঁচ বছর মেয়াদী সরকারী বিনিয়োগ সুকুক ইস্যুর নিলাম ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী বন্ড সাধারণত ‘সুকুক’ নামে পরিচিত। সুকুক একটি আরবী শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে সিলমোহর লাগিয়ে কাউকে অধিকার ও দায়িত্ব দেয়ার আইনী দলিল। সাধারণত সুকুকধারীরা সম্পদের মালিকানা লাভ করেন এবং মুনাফা পান। বাংলাদেশ ব্যাংক চার হাজার কোটি টাকা করে দুই দফায় বিনিয়োগকারীদের কাছে সুকুকের সার্টিফিকেট বিক্রি করবে। এর মাধ্যমে বন্ড বিক্রি করে সারাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের জন্য দুই দফায় ৮ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশে তালিকাভুক্ত বন্ডের বাজার এমনিতেই সংকুচিত, তারমধ্যে তালিকাভুক্ত বন্ডের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে কেবল ইসলামী বন্ড ‘সুকুক’র বাজার বৃদ্ধিকরণে তালিকাভুক্ত বন্ডের বাজার আরো সংকুচিত হয়ে আসবে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগ করার আগ্রহ কমে যেতে পারে বলে মনে করেন তারা।
সরকার ধর্মকে পুঁজি করে প্রচলিত বন্ড বাদ দিয়ে শরিয়াহ ভিত্তিক ইসলামি বন্ড চালু করতে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন বিভিন্ন মহল। দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইসলামি দলগুলোর সাথে সরকারের গোপন কোনো সমঝোতা বলেও কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেন। দেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতে ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানার কৌশল হিসেবে সরকার এই উদ্যোগ নিয়ে থাকতে পারেন বলে সন্দেহের তীর ছুঁড়ছেন বলে মনে করছে অনেকেই। সম্প্রতি ভাস্কর্য ইস্যুতে তৈরী বিতর্কে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিককালে গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ কার্যক্রম চালিয়ে নিতে ইসলামি দলগুলোর সাথে সরকারের গোপন সমঝোতা হয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। আবার অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেন, ইসলামি বন্ড ‘সুকুক’ চালু করার উদ্দেশ্যে ইসলামি দলগুলোকে ভাস্কর্য ইস্যুতে মাঠে নামতে পারে। অর্থ্যাৎ, ইসলামী বন্ড চালুর পূর্বপ্রস্তুতি হতে পারে ভাস্কর্য্য বিতর্ক। কেউ কেউ এমনও মনে করছেন, দেশব্যাপি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ প্রকল্প চালু রাখার জন্য সরকার একরকম চাপে পড়ে ইসলামি বন্ড ‘সুকুক’ চালু করে থাকতে পারেন।
সর্বপরি অভিজ্ঞমহল মনে করছেন, সরকার শেষ পর্যন্ত সেই ধর্মকে পুঁজি করেই অর্থ সংগ্রহ করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ‘সুকুক’ নামের ইসলামি বন্ডটি দেশের অর্থনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করার একটি সরকারী প্রকল্প ছাড়া ভিন্ন কিছু নয় বলেই মনে করছেন অনেকেই।
এসডাব্লিউ/ডিজে/কেএইচ/১৮৪২
আপনার মতামত জানানঃ