টানা দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত বিক্ষোভের জেরে অবশেষে বহুল আলোচিত-সমালোচিত নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ বিলুপ্ত করেছে ইরান। স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে রোববার বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
প্রসঙ্গত, ইরানের অ্যাটর্নি জেনারেল মহম্মদ জাফর মন্তেজারি একটি ধর্মীয় সম্মেলনে বলেছেন, ইসলামি নীতি- নৈতিকতা নিয়ে খবরদারি করার জন্য তৈরি সেদেশের বিশেষ পুলিশ বাহিনীকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
হিজাব না পরার জন্য এই বাহিনীর হাতে আটক মাহসা আমিনি নামে ২২ বছরের এক তরুণীর মৃত্যুর পর ইরানে গত আড়াই মাস ধরে চলা সহিংস বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে মোহাম্মদ জাফর মোনতাজেরির কাছ থেকে এই ঘোষণা এলো।
বিলুপ্ত নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ
উল্লেখ্য, কঠোর বিধি মেনে হিজাব না পরার অভিযোগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনিকে (২২) গ্রেপ্তার করে নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর পুলিশি হেফাজতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে তেহরানের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
১৬ সেপ্টেম্বর তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে দাবি করে ইরানের মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। বিক্ষোভ ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ রুখতে দমন-পীড়ন জোরদার করে ইরানি কর্তৃপক্ষ। এখন দেশটির কর্তৃপক্ষ নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ বিলুপ্তির ঘোষণা দিল।
তবে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী বা সরকারের আরও উঁচু মহল থেকে এমন সিদ্ধান্তের কথা এখনও নিশ্চিত করা হয়নি। উল্লেখ্য, নারীদের ইসলামি ড্রেস কোড বা পোশাক পরিধান সহ ইসলামি বিভিন্ন নীতি-নৈতিকতার প্রয়োগ নিশ্চিত করাই ছিল মরালিটি বা নৈতিকতা বিষয়ক এই পুলিশ বাহিনীর অন্যতম প্রধান কাজ।
তবে বিবিসি ফার্সি ভাষা বিভাগের সংবাদদাতা সিভাশ আরদালান বলছেন, মরালিটি পুলিশ ভেঙে দেওয়ার অর্থ এই নয় যে ইরানে হিজাব পরার বাধ্যবাধকতা রহিত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকার এই সিদ্ধান্ত যদি সত্যিই নিয়ে থাকে তাহলে তা তা চলমান বিক্ষোভ প্রশমিত করবে সে সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, বিক্ষোভকারীরা নতুন করে তিন দিনের ধর্মঘট ডেকেছে।
তবে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএফপি এবং লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ান সহ ডজন খানেক আন্তর্জাতিক মিডিয়া খবর দিয়েছে, হিজাব বাধ্যকতামুলক করে জারী করা আইনটি সরকার পুনর্বিবেচনা করছে।
শনিবার ইরানের সংবাদ সংস্থা আইএসএনএ মি. মোনতাজেরিকে উদ্ধৃত করে খবর দিয়েছে (হিজাব বাধ্যতমুলক করার) আইনটিতে পরিবর্তন আনার কোনও পথ রয়েছে কিনা “পার্লামেন্ট এবং বিচার বিভাগ তা খুঁটিয়ে দেখছে।“
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পর্যালোচনা কমিটি বুধবার পার্লামেন্টের সংস্কৃতি বিষয়ক কমিশনের সাথে বৈঠক করেছে। এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ফলাফল জানা যাবে।
মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ১৬ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া সহিংস বিক্ষোভে সরকারি হিসাবেই মৃত্যুর সংখ্যা দুশ ছাড়িয়ে গেছে। রাজধানী তেহরানসহ বেশ কিছু শহরে বহু নারী প্রতিবাদ জানাতে হিজাব পরছেন না।
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বছর চারেক পর ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে নারীদের মাথার চুল ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক করে আইন জারী করা হয়।
এদিকে বিক্ষোভে প্রাণহানির সংখ্যা প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে ইরান। শনিবার দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা পরিষদ এক বিবৃতিতে জানায়, চলমান পরিস্থিতিতে গত সেপ্টেম্বর থেকে দুইশরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
তবে এটি আন্তর্জাতিক ও দেশটির বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার দেওয়া হিসাবের চেয়ে অনেক কম। বিক্ষোভে এরই মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও বিক্ষোভকারী মিলিয়ে তিনশর বেশি মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী।
উল্লেখ্য, ইরানি কর্তৃপক্ষ চলমান বিক্ষোভকে ‘দাঙ্গা’ হিসেবে উল্লেখ করছে। তাদের ভাষ্য, বিদেশি শত্রুরা এ বিক্ষোভে মদদ দিচ্ছে। বিক্ষোভে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কমপক্ষে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এদিকে মূলত ইরানের নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ চোখ রাঙানিতেই সে দেশের মহিলাদের অবাধ স্বাধীনতার গায়ে চেপেছিল ‘শালীনতা বোধের’ আবরণ। যে খোলা চুল কৃষ্ণ সাগরের সৈকতে নিশ্চিন্তে উড়ত তাতে বসেছিল হিজাবের নিষেধ। তবে নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশের বিলুপ্তির সাথে অনেকেই প্রত্যাশা করছে, নারীরা ফিরে পাবে সেই স্বাধীনতা।
ফিরে পাবে পুরনো স্বাধীনতা?
দেশটিতে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের ইরানি সমাজে নারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বিপ্লবের পরপরই দেশটির নারীদের হিজাব পরতে বাধ্য করা হয়। সেইসঙ্গে নারীরা তাদের অনেক অধিকারও হারান। যার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণ ও কাজের অধিকার এবং সাত বছরের বেশি বয়সী সন্তানকে রাখার বিষয়ও।
তবে একটা সময় হিজাব পরার পাশাপাশি জিন্স, মিনি স্কার্ট এবং শর্ট-হাতা টপ পরেও ইরানের রাস্তায় স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারতেন সেই দেশের মহিলারা। সমুদ্রসৈকতে বিকিনি পরেও ঘুরতে দেখা যেত সে দেশের মহিলাদের। সেই সময়ের তোলা ছবি বলছে ইরানের বিভিন্ন শহরে হিজাব বা বোরখা ছাড়াই পথে নামতেন ইরানি মহিলারা। তাদের পরনে থাকতে আধুনিক পোশাক-আশাকও।
শৌখিন ছিলেন ইরানের মহিলারাও। বাহারি জুতো পরতেও দেখা যেত তাদের। চোখে থাকত হাল ফ্যাশনের রোদচশমা। ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ভর্তির সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। গ্রামে বসবাসকারী রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েরা যাতে বাড়ি থেকে দূরে পড়াশোনা করার সুযোগ পান, তা নিয়েও উদ্যোগী হয়েছিল প্রশাসন।
পিকনিক ছিল ইরানি সংস্কৃতির একটি জনপ্রিয়তম অঙ্গ। পরিবার এবং বন্ধুদের নিয়ে প্রতি শুক্রবার একত্রিত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল সেই সময়। সবাই মিলে এক হয়ে পিকনিকে যেত ইরানের বহু পরিবার। সেই সব জায়গায় খোলমেলা পোশাকেই দেখা যেত মহিলাদের।
এসডব্লিউএসএস/০৮২০
আপনার মতামত জানানঃ