বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমদানি করা ডিজেলের বড় অংশ পরিবহন খাত এবং কৃষিকাজে সেচের কাজে ব্যবহার হয়। জ্বালানি তেলের জন্য ২০২১ সালে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল বাংলাদেশের সরকার। তবে এই বছর তেলের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি অনেকটাই সমন্বয় করা হয়েছে।
তবে আইএমএফ বলছে, মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির সংস্কার করা হলে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেয়ার প্রবণতা কমে আসবে। এখন সেই দিকেই হাঁটছে সরকার। যদিও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় পৌঁছেছে। গতকাল ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল বিক্রি হয়েছে ৮১.২০ ডলারে।
সোমবার সরকার আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, এখন থেকে বিইআরসি বা গণশুনানি ছাড়াই প্রয়োজনে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করতে পারবে সরকার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অপরিশোধিত তেল আমদানিকারক চীনের ক্রেতাদের চাহিদা ও উদ্বেগের জেরে আন্তর্জাতিক বাজারে কমে গেছে জ্বালানি তেলের দাম।
গতকাল সোমবার ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ তথা ২ দশমিক ৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ২০ মার্কিন ডলারে। আগের ধাপে যেখানে ৩ শতাংশ বাড়ার আগে ছিল ৮০ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং গত ৪ জানুয়ারির পর থেকে সবচেয়ে কম।
এদিকে বাংলাদেশ সরকার বেসরকারিভাবে জ্বালানি আমদানিতে সায় দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ফুয়েলসহ অন্যান্য এনার্জি বেসরকারিভাবে আমদানির ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা নিয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখার জন্য নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গত সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনার পর সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সরাসরি বৃদ্ধি এবং কমানোর বিষয়ে সরকারের ক্ষমতার বিধান। উল্লেখ্য, বর্তমানে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এক্ষেত্রে কিছু জটিলতা রয়েছে। এতে গণশুনানির পর সিদ্ধান্ত নিতে ৯০ দিন সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যে তেলের দাম কম-বৃদ্ধির তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এজন্য সরকার এখন থেকে প্রয়োজনবোধে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেবে।
সুবিধা অসুবিধার প্রকৃত চিত্র
এবার আসুন প্রকৃত সত্য জানা যাক। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বরাবরই জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি কমানো এবং এটির দর বাজারমূল্যে নির্ধারণের তাগিদ দিয়ে আসছেন। তারা বলেছেন, ভর্তুকিও আসলে জনগণের টাকা থেকেই দিতে হয়। কিন্তু ভর্তুকি কমাতে পারলে সেটা সরকার অন্য খাতে ব্যয় করতে পারবে।
তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বেসরকারিভাবে জ্বালানি আমদানি করার মধ্যে ভালো কিছু্ই নেই। সরকারের জ্বালানি নীতির অভিজ্ঞতা থেকে মনে করছি, জাতীয় সক্ষমতা বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে এমন আমদানিনির্ভরতার কারণে। প্রথমত, সরকার জ্বালানি খাতের আমদানিনির্ভরতা বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকার এখন বেসরকারি খাতে দিয়ে দিচ্ছে।
আমরা দেখেছি, বিপিসি ফার্নেস অয়েল আমদানি করলে প্রতি লিটারে ব্যয় হয় ৭২ টাকা। সেটা বেসরকারি খাত থেকে কিনছে ৯৪ টাকা লিটারে। তার মানে প্রতি লিটারে ১৬ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে সরকারকে। এরকম ব্যবসা পৃথিবীর কোথাও আছে কি না আমার জানা নেই। গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য এমন সিদ্ধান্ত। সরকারের জ্বালানি নীতি সর্বনাশ ডেকে আনছে।
বাংলাদেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলছেন, ‘’সরকার যখন জ্বালানি তেল বিক্রি করে, তখন আমরা ধরে নিতে পারি, সরকার সেটা লাভ করার জন্য করে না। সুতরাং জনগণ যে দামে স্বস্তি পাবে, সেই দামেই তাদের দেয়ার কথা।‘’
‘’কিন্তু যখন সেটা প্রাইভেট সেক্টরে যাবে, তখন তাদের উদ্দেশ্যই থাকবে ব্যবসা করা বা লাভ করা। সেক্ষেত্রে দামের ওপর তারা একটা নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করবে। সাধারণ মানুষের সুবিধা তাদের মুল উদ্দেশ্য হবে না। তারা হয়তো নানাভাবে দাম বাড়াতে চাইবে। সেটা সবার জন্য একটা অসুবিধা তৈরি করবে। ‘’
বাংলাদেশে অবশ্য অতীতে দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম অনেক কমে গেলেও সেখানেও সরকার বেশি মূল্যে বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে।
বর্তমানে লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপি গ্যাসের দাম সরকারিভাবে বেঁধে দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের দর, আমদানি ও পরিবহন খরচ, মুনাফা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে প্রতিমাসে একবার এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা।
জ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রিতে বেসরকারি খাত যুক্ত করা হলেও দাম নির্ধারণে এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড. বদরুল ইমাম বলছেন, ‘’আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে তারা দামটা নির্ধারণ করবে কিনা। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে সরকারের একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার, কিছু বাধ্যবাধকতা থাকা দরকার যে, দামটা কীভাবে নির্ধারণ করা হবে। আসল কথা হলো, প্রাইভেট সেক্টরে গেলেও দামটা যেন তাদের ইচ্ছামতো নির্ধারণ করা না হয়, সেখানে যেন নিয়মনীতি ও নজরদারি থাকে।‘’
এসডব্লিউএসএস/২১১৫
আপনার মতামত জানানঃ