বর্তমানে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করার সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ভুয়া ঠিকানায় কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ঋণ নেওয়া। তবে এ জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মালিকপক্ষ ও ব্যবস্থাপনার যোগসাজশ লাগবে। আর প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক সম্পর্কগুলো ব্যবহার করা। এতে চুপ থাকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার নামে-বেনামে অনেকগুলো কোম্পানি খুলে তারপরই দখল করেছিলেন একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তিনি অবশ্য শিখেছিলেন আরেক বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রধানের কাছ থেকে। ব্যবসায়ী গ্রুপের সেই প্রধান শিখেছিলেন আবার দেশের একজন ব্যবসায়ী নেতার কাছ থেকে। তিনি মূলত এ পদ্ধতিতে কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তুলে নিতেন।
ব্যাংকিং সূত্রগুলো জানায়, একসময় ব্যবসায়ীরা নিজের কোম্পানির নামে ব্যাংক থেকে ইচ্ছেমতো ঋণ নিতেন। এক প্রতিষ্ঠানের কাছে যাতে বেশি ঋণ চলে না যায়, এ জন্য সীমা আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরই শুরু হয় অন্যের নামে, ভুয়া নাম–ঠিকানা ব্যবহার করে সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া।
আবার অনেকে কোম্পানি না খুলে শুধু ট্রেডিং লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা করছেন। ব্যাংক থেকে তুলে নিচ্ছেন টাকা। সেই টাকা ব্যাংকে ফেরতও দিচ্ছেন না। এমন প্রথা বেশ পুরোনো। সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকও প্রায় ধ্বংসের পথে গিয়েছিল এসব কারণেই। এখন প্রশ্ন উঠছে, কে ঠেকাবে এ অব্যবস্থাপনা। কেন ভুয়া নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে ঋণ নেওয়া বন্ধ হচ্ছে না। কমছে না খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যখন ব্যাংকের মালিকপক্ষ ভুয়া কোম্পানির নামে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে, তখন তা ঠেকানো কঠিন। কারণ, ব্যাংক কর্মকর্তারা চাকরি হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারে না। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ নজরদারি ও সদিচ্ছা থাকে, তাহলেই সম্ভব আমানতকারীদের অর্থের সুরক্ষা দেওয়া। তবে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি কম, এ জন্য আমানতকারীদের অর্থেরও সুরক্ষা সেভাবে দেওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, ২০১১ সালে আলোচিত হল–মার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাৎ করতে যেসব কোম্পানির নাম ব্যবহার করে, তার কয়েকটি ছিল কাগজনির্ভর। অর্থাৎ এসব কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এতে সোনালী ব্যাংকের লোকসান হয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। যার পুরোটাই এখন খেলাপি। ব্যাংকটি সেই ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
২০১৪-১৫ সালে অ্যাননটেক্স গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়। এ জন্য ২২টি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে গ্রুপটি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বের হয়, মাত্র চারটি কোম্পানি পূর্ণাঙ্গ। অনেকগুলোই কাগুজে। আর এসব কোম্পানির মালিক বানানো হয় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এসব ঋণের বড় অংশ এখন খেলাপি। ফলে জনতা ব্যাংক এখন ঋণখেলাপিতে শীর্ষ।
বেসরকারি খাতের ইউনিয়ন ব্যাংকে ভল্ট কেলেঙ্কারির ঋণেও বড় অনিয়ম ধরা পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে। শুধু ট্রেড লাইসেন্সের ভিত্তিতে কোম্পানি খুলে ঋণের বড় অংশই বের করে নেয় প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্সও ছিল না। কাগুজে এসব কোম্পানিকে দেওয়া ঋণের বেশির ভাগেরই খোঁজ মিলছে না এখন। ফলে এসব ঋণ আদায়ও হচ্ছে না।
ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। একইভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকেও বড় অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংক দুটি এখনো এসব ঋণ খেলাপি করেনি। মেয়াদ বাড়িয়ে ও পুনঃ তফসিল করে ঋণগুলো নিয়মিত দেখাচ্ছে ব্যাংক দুটি।
এবার একই ধরনের ঘটনা ধরা পড়েছে ইসলামী ব্যাংক। যেসব প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকটির এমন ঋণ দেওয়া শুরু হয় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে। ব্যাংকটির যেসব কর্মকর্তা এতে সহায়তা দেন, তাঁদের দ্রুত পদোন্নতি হয়েছে। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ঋণসংক্রান্ত বিভাগগুলোতে। এর মাধ্যমে বের করা হচ্ছে ভুয়া ঋণ। এসব ঋণের মেয়াদ দেওয়া হচ্ছে বেশি, যাতে সহজেই খেলাপি না হয়। ভুয়া কোম্পানি খুলে ঋণ নয়, দেশের তিনটি ব্যাংক দখলের সময়ও এমন কিছু কোম্পানির নাম ব্যবহার হয়েছিল।
এমন পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যখন বাংলাদেশ ব্যাংক নিষ্ক্রিয় থাকে, তখন ইসলামী ব্যাংকের মতো ভালো ব্যাংকগুলো শেষ হয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। একজন ব্যক্তি ও তাঁর পরিবার ব্যাংক খাতকে বড় ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। এটা সরকার জেনেও চুপ, প্রতিরোধের কোনো সদিচ্ছাও নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও দুর্নীতি দমন সংস্থা চাকরি হারানোর ভয়ে আর কত দিন চোখ বন্ধ রাখবে।’
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘ব্যাংকটির যে ডলার আয় হয়, তা মালিকদের কোম্পানির আমদানিতে খরচ করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। অন্য কাউকে ব্যবসা করার সুযোগ দিচ্ছে না। ফলে পুরো ভোগ্যপণ্যের বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ক্ষতি হচ্ছে পুরো দেশের।’
মূলত দেশে এখন প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং যেসব বিবেচনায় ২০০৯ সাল থেকে দফায় দফায় ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, তাতে অর্থনীতির স্বার্থ কিংবা জনগণের আর্থিক লেনদেনের যুক্তিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। প্রয়োজনাতিরিক্ত জেনেও নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বজনপ্রীতির তাগিদে।
এ দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ সংকট যত গুরুতরই হোক, দেশের প্রায় প্রতিটি প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংক প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মুনাফা করে যাচ্ছে। অতএব, ব্যাংকের লাইসেন্স যারা বাগাতে পেরেছেন, তারা এ দেশে অতি সহজেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান ওই মুনাফার ভাগ পাওয়ার কারণে। সেজন্যই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ক্ল্যাসিক নজির হলো ব্যাংকের মালিকানা বণ্টনের এই রাজনৈতিক দুর্নীতি।
আর এ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের অনেকেই তাদের রাজনৈতিক কানেকশনের জোরে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স পেয়ে বিনা মূলধনে অন্য ব্যবসায়ীদের অর্থে তাদের ব্যাংকের উদ্যোক্তা-পরিচালক বনে গেছেন। মানে তার শেয়ারের জন্য বিনিয়োজিত পুঁজিও হয়তো ব্যাংকের অন্য পরিচালকরা পরিশোধ করে দিয়েছেন। এ পরিচালকদের সিংহভাগ আবার দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, যারা ব্যাংকের মালিকানা পেয়ে এ দেশের ব্যাংকঋণের ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করে ফেলেছেন।
ব্যাংক কোম্পানি আইনে নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে তাদের ওপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলেও একে অন্যের ব্যাংক থেকে দেদার ঋণগ্রহণের সংস্কৃতি (লোন সোয়াপ) এ দেশে ভয়াবহ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। দেশের কয়েকজন রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী বিভিন্ন পন্থায় নানা নামে একাধিক ব্যাংকের বিপুল শেয়ার কিনে নেয়ার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে নিয়ে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী নাকি এখন সাতটি ব্যাংকের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন! ব্যাংকগুলোর ঋণ নিয়ে ওই ব্যবসায়ী নয়-ছয় করছেন বলে ব্যাংকারদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেনামি ঋণে নাকি সয়লাব হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। একজন ব্যক্তিকে এতগুলো ব্যাংকের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দিয়ে পুরো ব্যাংকিং খাতকে বড়সড় ঝুঁকিতে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের অভিমত। দেশের ‘কমপিটিশন অ্যাক্ট’ তো এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কথা! ব্যাংকের মালিকানায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এত সহজ সুযোগ অন্য কোনো দেশে চালু আছে কিনা, জানা নেই। আর্থিক খাতে ভবিষ্যতে ধস নামলে কিংবা ব্যাংকিং খাত কোনো মহলের ব্ল্যাকমেইলের শিকার হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এসডব্লিউএসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ