আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের বড় দরপতন হয়েছে। গত কয়েক দিনে টানা কমে নেমে এসেছে ৮০ ডলারের নিচে, যা দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে দেশে তেলের দাম কমানোর এখনো কোনো চিন্তাভাবনা করছে না সরকার।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ডব্লিউটিআই অপরিশোধিত তেল ৭৯ ডলার ১১ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। তবে দাম কমেনি দেশীয় বাজারে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে দেশের বাজারে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে দেশেও দাম বাড়ায় সরকার। দাম বাড়ানোর সময় বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশের বাজারেও দাম সমন্বয় করা হবে। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমে গেছে বিশ্ববাজারে। কিন্তু দেশের বাজারে এখন পর্যন্ত দাম কমানোর কোনো লক্ষণ নেই। সহসাই জ্বালানি তেলের দাম কমবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সুখবর। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ৮০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মন্দার আশঙ্কার মধ্যে এই সুখবর এসেছে। যে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য বিশ্ব অর্থনীতিতে ওলটপালট করে দিচ্ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে সেই তেলের বড় দরপতন হয়েছে। গত কয়েক দিনে টানা কমে নেমে এসেছে ৮০ ডলারের নিচে, যা দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবে দেশে তেলের দাম কমানোর এখনো কোনো চিন্তাভাবনা করছে না সরকার।
কেন দাম কমছে আন্তর্জাতিক বাজারে?
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ডব্লিউটিআই অপরিশোধিত তেল ৭৯ ডলার ১১ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেল বিক্রি হয়েছে ৮৭ ডলার ১১ সেন্টে। এক সপ্তাহ আগে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৯০ ডলারের বেশি ছিল। ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ছিল ৮৫ ডলারের বেশি।
গত ২২ সেপ্টেম্বর ডব্লিউটিআই ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের দাম ছিল ৭৯ ডলার ১২ সেন্ট। আর ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ৮৬ ডলার ৩৯ সেন্ট।
মূলত বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কায় জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী হয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের বিভিন্ন শহরে এখনো লকডাউন চলছে। কোথাও কোথাও লকডাউনবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। কিন্তু সরকার অনড়। সে কারণে দেশটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থিমিত হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা বলছে, চীনে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবার বেশ খানিকটা কমবে। অন্যদিকে আমেরিকান মুদ্রা ডলার দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। ক্রমবর্ধমান সুদের হার বড় অর্থনীতিকে মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ আশঙ্কায় তেলের দাম কমছে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় বড় দেশ ঋণের সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে। অন্য বড় অর্থনীতির দেশগুলোও সেই একই পথ অনুসরণ করছে। আর এটিই বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে। এর জেরেই বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘বিশ্বে কী মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় সংকটে বিশ্ব অর্থনীতি। দিন দিন বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার একযোগে বাড়িয়েই চলেছে। এর জেরে বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের বড় বড় শহরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এখনো লকডাউন শুরু হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চাহিদা কমায় জ্বালানি তেলের দাম কমেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থাটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত দুটি কারণে তেলের দাম নিম্নমুখী হয়েছে। প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা মোটেও ভালো নয়। উন্নত দেশগুলোতে মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই তেলের চাহিদা কমছে। দ্বিতীয়ত, ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দর।
ডলার প্রাইস ইনডেক্সের তথ্যানুসারে, চলতি বছর ডলারের দর ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডলারের দর বাড়লে আমদানি মূল্য বেড়ে যায়, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে। সে জন্য ডলারের দর বাড়লে উন্নয়নশীল দেশগুলো জ্বালানি তেল আমদানি হ্রাস করে, বাংলাদেশও যা করেছে। ডলার বাঁচাতে দেশে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম না কমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করা হবে।
দেশে কেন কমছে না দাম?
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের দেশে দাম একবার বাড়লে আর কমার কোনো রেকর্ড নেই। তবে এবার জ্বালানি তেলের দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছে তা দ্রুতই সমন্বয় করতে হবে। নয়তো সমাজে একটি ভয়ঙ্কর বৈষম্য তৈরি হবে। সাধারণ জনগণের ভোগান্তি কমাতে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কোনো বিকল্প নেই।’
তবে খুব দ্রুত জ্বালানি তেলের দাম কমছে না বলে জানিয়েছেন বিপিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার তো এই বাড়ে এই কমে। আমরা তো আর সেভাবে প্রতিদিন বাড়াতে বা কমাতে পারব না। এখন দাম কম আছে, তাই যদি আমরা কমিয়ে দেই আর পরদিনই যদি দাম বেড়ে যায় তবে? আমরা আরো কয়েক দিন পর্যবেক্ষণের কথা ভাবছি।
বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম গড়ে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি ওঠানামা করছিল, ঠিক তখন বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। গত ৫ আগস্ট সরকার, ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা আর অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করে। এর পর থেকেই বাস, ট্রাক, অ্যাপের প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, লঞ্চ ও হিউম্যান হলারের ভাড়া বেড়ে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি ছিল, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তা আরও একদফা বাড়ে। সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি এক লাফে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে।
সরকারের মন্ত্রীরা অবশ্য বলে আসছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কাছুটা কমলে দেশের বাজারে লিটারে মাত্র পাঁচ টাকা কমানো হয় ৩০ আগস্ট। তখন দুই ধরনের তেলের দামই ছিল ৯০ ডলারের উপরে।
মন্দাভাবের কারণে বিশ্ববাজারে দাম কমার ধারা কতদিন অব্যাহত থাকবে, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ আছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, দাম কমতে থাকলে ওপেক তেল উত্তোলন আরও হ্রাস করবে। এতে দাম খুব একটা না-ও কমতে পারে।
দেশের বাজারে তেলের দাম কমানো হবে কী না- এ বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করছি। গত দুই মাস ধরে বাজার উঠানামা করছে। গত কয়েক দিনে অবশ্য বেশ খানিকটা কমেছে। আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। যদি ৭৫ ডলারের নিচে নেমে আসে, তাহলে হয়তো সরকার চিন্তাভাবনা করবে।’
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়। গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে দুই ধরনের তেলের দামই ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশ সরকারও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন ৮০ টাকা নির্ধারণ করে।
রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা করলে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তেলের দাম। একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেল ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে ওঠানামার মধ্যেই তেলের দর ১১০ থেকে ১১৫ ডলারের মধ্যে ছিল। গত মে মাসের শেষের দিকে তেলের দাম বেড়ে ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
২০২০ সালের করোনা মহামারির শুরুতে সারা বিশ্বে যখন লকডাউন চলছিল, তখন জ্বালানি তেলের দাম মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ এক ব্যারেল তেল কিনলে ক্রেতাকে উল্টো ৩৭ ডলার দেয়া হয়েছে। এরপর ওপেক ও রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে তেল সরবরাহ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৪২ ডলার। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৪৯ ডলার। এর পর থেকে গড়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ফেব্রুয়ারিতে ৫৩ ডলার, মার্চে ৬০, এপ্রিলে ৬৫, মে-তে ৬৪, জুনে ৬৬, জুলাইয়ে ৭৩ এবং আগস্টে ৭৪ ডলার। অক্টোবরে এই দাম ৮৫ ডলারে ওঠে। সে সময়ই দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ানো হয়।
এরপর অবশ্য তেলের দাম খানিকটা কমে আসে। যুদ্ধের কারণে ফের তা বাড়তে থাকে। ইউক্রেনে রুশ হামলার সঙ্গে সঙ্গে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ