বিশ্বের অন্যতম পরিবেশবান্ধব নগরী রাজশাহী। তবে এক উন্নয়ন প্রকল্পে বদলে যাচ্ছে মহানগরীর সেই চেনা রূপ। প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোপ পড়েছে সবুজের ওপর। পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই কাটা হয়েছে একে একে ২ হাজার ২৭৮টি বড় গাছ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে যেন নগরী আজ ‘বৃক্ষশূন্য’।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) জনসংযোগ দপ্তরের তথ্য মতে, ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯৩১ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার টাকা। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠকে (একনেক) মেগা প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। এরই মধ্যে ১ হাজার ২১৫ কোটি ২৬ লাখ টাকার টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ১ হাজার ৪০ কোটি ৫৮ লাখ টাকার। বাকি কাজ আগামী অর্থবছরের মধ্যে শেষ করার আশা রাসিকের। বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই মেগা প্রকল্পের নামে বৃক্ষ নিধন হুমকিতে ফেলবে রাজশাহী নগরীর পরিবেশ-প্রতিবেশ। তাই এ কাজকে ঘিরে উন্নয়ন, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো স্বার্থ জড়িত তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
জানা গিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় নগরীর তালাইমারী মোড় থেকে কাটাখালী বাজার পর্যন্ত ছয় লেন সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। ৪ দশমিক ১০ কিলোমিটার সড়কের মাঝে থাকবে ২ মিটারের সড়ক বিভাজক। আর সড়ক বিভাজকের দুই পাশে থাকবে ১০ দশমিক ৫ মিটারের সড়ক। সড়কের উভয় পাশে থাকছে ৩ মিটার অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের লেন ও উভয় পাশের ৩ মিটার ফুটপাত ও ড্রেন। সড়কটির সৌন্দর্য বাড়াতে করা হবে বৃক্ষরোপণ। রাসিক বলছে, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এটি হবে বিশ্বমানের একটি সড়ক। যদিও সড়কটি (বিআর-২) নির্মাণকাজে কাটা পড়েছে ৬২১টি মেহগনি, কড়ই, নিমসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এসব গাছের সবই ২০-৫০ বছর বয়সী।
এছাড়া নগরীর বন্ধগেট থেকে সিটি হার্ট পর্যন্ত দুই লেন সড়কটির দুই পাশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। মেগা প্রকল্পের আওতায় সড়কটি এখন চার লেন হচ্ছে। আর তাতে ব্যয় হচ্ছে ৪৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। রাসিক বলছে, ৩ দশমিক ৫৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটি ৮০ ফুট প্রশস্ত করা হবে। উভয় পাশে ২২ ফুট করে ৪৪ ফুট রাস্তা, রাস্তার উভয় পাশে ৬ ফুট করে মোট ১২ ফুট ড্রেন ও ফুটপাত এবং ফুটপাত ও ড্রেনের উভয় পাশে ১০ ফুট করে ২০ ফুট ধীরগতির যানবাহন চলাচলের সড়ক, সড়কে ৪ ফুটের বিভাজক নির্মাণ করা হবে। আর এসব বানাতে গিয়ে করাত চলেছে ৮৮৭টি গাছে।
নগরীর ভদ্রা মোড় রেলক্রসিং থেকে পারিজাত লেক হয়ে নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত ৪ দশমিক ১৭ কিলোমিটার সড়কটি দীর্ঘদিন বেহাল অবস্থায় পড়েছিল। সেটিও পাল্টে যাচ্ছে এ মেগা প্রকল্পের আওতায়। সড়কটি প্রশস্ত হচ্ছে ৮০ ফুট। চার লেনের সড়ক ছাড়াও দুই লেনের অযান্ত্রিক যানবাহন লেন, সড়ক বিভাজক ও দুই পাশে ড্রেন ও ফুটপাত নির্মাণ হচ্ছে। রাসিক বলছে, এ সড়ক চওড়া করতে গিয়ে কাটা পড়েছে ৪৪৮টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। ৪ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকায় এ গাছ কিনে নিয়েছে মেসার্স জিয়া টিম্বার অ্যান্ড ফার্নিচার প্যালেস। তবে সামাজিক বন বিভাগ বলছে, এ সড়কে গাছ কাটা হয়েছে ৪৯৮টি। বাকি ৫০টি গাছের হদিস নেই।
মেগা প্রকল্পের আওতায় নগরীর পোস্টাল একাডেমি থেকে ম্যাচ ফ্যাক্টরি রাস্তাটিও চওড়া করছে রাসিক। এতে উজাড় হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ১৬৩টি গাছ। ভেড়িপাড়া বেন্টুর খড়ির আড়তের সামনে থেকে হাই-টেক পার্ক হয়ে ঢালুর মোড় পর্যন্ত সড়কের ৭৭টি এবং বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের সামনের রাস্তায় ১৪টি গাছ কাটা পড়েছে। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পাশে সীমানাপ্রাচীর ও ড্রেন নির্মাণে কাটা পড়েছে ছয়টি গাছ। সিএন্ডবি মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনেও কাটা পড়েছে ১২টি গাছ। এছাড়া রাজশাহী-নওহাটা-চৌমাসিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এ প্রকল্পে কোপ পড়েছে নগরীর আরো ৪৪৫টি গাছে, যেগুলোর বয়স ২০-৫০ বছর। সড়ক ও জনপথ বিভাগের বৃক্ষপালনবিদ দপ্তর এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এ প্রকল্পের বাইরেও ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে নগরীর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ১ হাজার ৬৫৯টি গাছ কাটা পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৪৯টি গাছ কাটা পড়েছে মৃত্তিকা ভবন নির্মাণে। এছাড়া বিসিক শিল্প নগরী-২ স্থাপনে ৩২৩টি, রামেক হাসপাতালে ২৩৮টি, রুয়েট ভবন নির্মাণে ৭৩, রাজশাহী পলিটেকনিকের ৮৭, বক্ষ্যব্যাধি হাসপাতালের ৫৩, রাজশাহী টেক্সটাইল মিলের ৫৩, ক্যান্সার হাসপাতালে ৪৩, টিটিসির ৪২, পোস্ট মাস্টার জেনারেলের কার্যালয়ের ৪১, রাজশাহী কলেজের ৩১, কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকার ১৪ ও বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কের ১৪টি গাছ কাটা পড়েছে।
রাজশাহীর প্রবীণ সাংবাদিক ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, পরিবেশ রক্ষা করে অবকাঠামো উন্নয়নের নকশা প্রণয়ন করেন ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচাররা। রাজশাহীর ক্ষেত্রে হয়তো এ প্রকল্প ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচাররা তৈরি করেননি। ফলে উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে পরিবেশ সুরক্ষা। এটা পরিবেশের ওপর এক ধরনের বর্বরতা। এতে ‘সবুজ নগরী’ হিসেবে রাজশাহীর যে খ্যাতি ছিল সেটি ম্লান হতে বসেছে।
গাছ কাটলে পরিবেশের ওপর এর একটা প্রভাব পড়বেই—এমন মন্তব্য করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সিতাংশু কুমার পাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, প্রতিটি গাছের জীবনচক্র রয়েছে। জীবনকাল পেরিয়ে গেলে গাছ কাটলে সমস্যা নেই। পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় করে উন্নয়নের তাগিদ দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সরওয়ার জাহান সজল। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী সব উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশ সুরক্ষিত রেখে। তবে উন্নয়ন করতে গেলে কিছু গাছ কাটা পড়বেই। এখন বিষয় হলো, কী পরিমাণ গাছ কাটা হলো তার সঙ্গে পরিবকল্পনা করে কী পরিমাণ গাছ লাগানো হচ্ছে সেটি ভাবতে হবে।
পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই গাছ কাটার বিষয়টি স্বীকার করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম। তিনিই ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। প্রকৌশলী নূর ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সড়ক চওড়া করতে গিয়ে কিছু গাছ কাটা পড়েছে। সড়ক নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার গাছ লাগানো হয়েছে। যেসব সড়কে নির্মাণকাজ চলমান, সেগুলোতেও গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ