উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক অনুসারে দেশের বর্তমান চেহারা ভিন্ন হওয়ার কথা। আমাদের গত এক দশকের উন্নয়নের সূচকগুলো ঊর্ধ্বমুখী ছিল। সম্প্রতি আমাদের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২-এর হিসাবে মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। চরম দরিদ্র ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি মূল্যে জিডিপির পরিমাণ ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। উন্নয়নের হুলুস্থুল কাণ্ড এই সূচকগুলোকেই সমর্থন করে। বড় বড় ব্রিজ, টানেল, রোড, বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাসপাতাল, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, দুস্থ ব্যক্তিদের বাড়ি করে দেওয়া—কী নেই এ উন্নয়নের তালিকায়।
কিন্তু কেবল পরিসংখ্যান বা সূচক দিয়ে দুনিয়া চলে না। আবার সেই সূচক যদি হয় গোঁজামিলে ভরা, তাহলে তো কথাই নেই। সূচকের ভিত্তিতে সব চললে যোগ-বিয়োগ করে হিসাব মিলিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু বাস্তব জীবনের সঙ্গে হিসাবের অনেক ফারাক থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনায় এই ফারাক শাসকেরা পরিকল্পিতভাবেই করে থাকেন।
দেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলেই প্রকৃত চিত্রটা আরও পরিষ্কার হবে। সাধারণ মানুষ খুব বেশি স্বস্তিতে নেই। দ্রব্যমূল্য আকাশ ছোঁয়া। ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। ব্যয়ের হিসাব কাটছাঁট করেও জনসাধারণের হাতে খাবার কেনার পর্যাপ্ত অর্থ থাকছে না। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসাবে দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ যথাযথ পরিমাণ খাদ্য নিতে পারছে না। খাবার কিনতে অনেকে নিজেদের সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
অনেকেই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে অতিরিক্ত খরচ সামাল দিতে না পেরে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক জরিপে ৮৮ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, গত ছয় মাসে খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বড় আঘাত হেনেছে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়।
এছাড়া বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) সম্প্রতি তাদের এক গবেষণায় জানিয়েছে, দেশে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন, শিগিগরই সমাধানের লক্ষণ নেই। পাশাপাশি অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ। সংস্থাটি বলেছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
ফলে স্বল্প আয়ের মানুষের শুধু সবজি ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য পণ্য কিনতেই তার বেতনে সংকুলান হচ্ছে না। রাজধানীর সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর অন্যতম কাওরানবাজারের পাশাপাশি, তুরাগ এলাকার কামারপাড়াবাজার ও শান্তিনগর বাজারের বর্তমান অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক।
প্রসঙ্গত, বিভিন্ন ধরনের সবজির মধ্যে একটু বড় আকারের ফুলকপি প্রতিটি ৭০ থেকে ৯০ টাকা, বাঁধাকপি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, বেগুন ৬০ থেকে ৮০ টাকা, করল্লা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, পটল ৪০ থেকে ৫০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৫০ থেকে ৬০ টাকা, শিম ৮০ থেকে ১০০ টাকা, কচুর মুখি ৬০ থেকে ৭০ টাকা, কাঁকরোল ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ থেকে ৭০ টাকা, গাজর ১৪০ টাকা, টম্যাটো ১২০ টাকা, মুলা ৫০ টাকা, বরবটি ৭০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা, আলু ৩০ টাকা ও কাঁচামরিচ ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
সবজির দাম কমা প্রসঙ্গে কাওরানবাজারের বিক্রেতা মো. হাকিম বলেন, এবার তো সারা বছরই সবজির বাজার চড়া গেল। তবে কয়েক দিন আগে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের অনেক জায়গায় সবজিখেত নষ্ট হওয়ায় দাম আরো কিছুটা বেড়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী এক মাসের মধ্যে বাজারে শীত মৌসুমের সবজি পুরোদমে আসতে শুরু করবে। তখন সবজির দাম কমে যাবে বলে আশা করছি।
সবজির পাশাপাশি বাজারে মাছের দামও চড়া। গতকাল খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চাষের রুই ৩২০ থেকে ৩৫০, কাতল ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা, পাবদা ৪৫০ থেকে ৬০০, তেলাপিয়া ১৮০ থেকে ২৩০ টাকা, কই ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা, পাঙাশ ২১০ থেকে ২৪০ টাকা, শিং ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা, চিংড়ি ৫৫০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে; যা এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি।
ডিমের হালি এখনো ৫০ টাকা
নতুন করে আর ডিমের দাম না বাড়লেও এখনো বাড়তি দরেই তা বিক্রি হচ্ছে। গতকাল বাজারে প্রতি হালি ফার্মের ডিম বিক্রি হয় ৪৭ থেকে ৫০ টাকায়।
সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকালের খুচরা বাজারদরের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বর্তমানে বাজারে গত বছরের তুলনায় ২৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি দামে ডিম বিক্রি হচ্ছে।
বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দামও। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে গতকাল বাজারে তা ১৭৫ থেকে ১৮৫ টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়া দেশি সোনালি জাতের মুরগি ৩২০ টাকা, খাসির মাংস ৯০০ টাকা ও গরুর মাংস ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
চিনির সঙ্কট
গতকাল কাওরানবাজারের মেসার্স আল-আমিন ট্রেডার্স, আলী স্টোর, জব্বার স্টোর ও ভাই ভাই জেনারেল স্টোরসহ বেশ কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে চিনি পাওয়া যায়নি। অনেক ঘুরে দু-একটি দোকানে চিনি পাওয়া গেলেও বিক্রি করা হচ্ছে সরকারনির্ধারিত দরে চেয়ে বেশি দামে। শুধু তাই নয়, চিনির সঙ্গে অন্য পণ্য কেনার শর্তও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মিলগুলো থেকে এখনো বাজারে চিনি সরবরাহ করা হয়নি। কবে সরবরাহ করা হবে তাও জানানো হয়নি।
উল্লেখ্য, গত ৬ অক্টোবর সরকার প্রতি কেজি চিনিতে ছয় টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনির দাম ৯০ টাকা ও প্যাকেট চিনি ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, মূলত দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকেই বাজারে মিলাররা চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। তবে গতকাল কাওরানবাজারে দেশবন্ধু সুগার মিলকে ট্রাকে করে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ৯৫ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
চিনির বাজার স্বাভাবিক হওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি আবুল হাশেম ইত্তেফাককে বলেন, বাজারে চিনির সরবরাহ নেই বললেই চলে। মিলগুলো থেকে চাহিদামতো চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, মিলাররা গ্যাসসংকটের কারণে চাহিদামতো চিনি উৎপাদন করতে পারছেন না। চিনি উৎপাদন না বাড়লে বাজার স্বাভাবিক হবে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ