আমরা সবাই জানি বিয়ে নারী পুরুষের একটি বৈধ সামাজিক বন্ধন। ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ভেদে বিয়ের ধরণ, আচার-অনুষ্ঠানের ভিন্নতা রয়েছে। তবে এমন এক আজব রীতির দেশ রয়েছে যেখানে মৃতের সঙ্গে জীবিত মানুষের ‘ভূত বিয়ে’ দেওয়া হয়!
মৃত মানুষকে ঘটা করে বিয়ে দেওয়ার মতো পিলে চমকে যাওয়া বিয়ের ঘটনা ঘটে এশিয়াতেই। চীনের ‘শানসি’ প্রদেশে এমন বিয়েকে বলা হয় ‘গোস্ট ম্যারেজ’ বা ‘ভূতের বিয়ে’। মৃত ব্যক্তিকে বিয়ে দেওয়ার এই প্রথাকে বলা হয় ‘মিয়াং খুন’। এমন রীতি উত্তর ও মধ্য চীন, শানসি ও হেনান প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩ হাজারের বেশি সময় ধরে পালিত হয়ে আসছে।
চৈনিক বিশ্বাস মতে, একজন মৃতেরও জীবিতদের মতো চাওয়া-পাওয়া থাকে। পরকালে যাতে তারা সঙ্গীহীন না থাকে এই বিবেচনায় তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। পরকালে পর্যাপ্ত সুখী না হলে মৃতের আত্মা তার পরিবার পরিজনদের তাড়া করে বেড়াবে। এজন্য মৃতের আত্মাকে খুশি করার জন্য তাকে একজন সঙ্গী দেওয়া হয়। এমন অদ্ভুতুড়ে রীতি কেবল ‘অবিবাহিত’ মৃত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ইতিহাস যা বলে
প্রায় ২৫০০ বছরের পুরাতন ভূত বিয়ের ঐতিহ্য। চীনের প্রথম রাজ বংশের সময় হতে এই অদ্ভুত বিয়ের রীতি শুরু হয় বলে জানা যায়। চীনের প্রথম রাজবংশ হলো কিন। খ্রিষ্টপূর্ব ২২১ অব্দ হতে খ্রিষ্টপূর্ব ২০৬ অব্দ পর্যন্ত কিন রাজবংশ শাসন করেছে দেশটি। তবে ভূত বিয়ের রীতি বিস্তৃতি লাভ করে হান রাজবংশের সময় কাল হতে বলে মনে করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ২০৬ অব্দ হতে ২২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাদের শাসনকাল বলবৎ ছিল।
উদ্দেশ্য
অনেকের হয়তো মনে হতে পারে যে, ভূত বিয়ের রীতি প্রচলিত হওয়ার কারণটি আসলে কী ছিল? অদ্ভুত সব রীতি-নীতি বা ঐতিহ্য প্রচলিত হয়েছে সাধারণত কোনো এক বিশ্বাস হতে। সেটি ধর্মীয় বা সামাজিক বিশ্বাসও হতে পারে। তবে এসব অচার অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যই থাকে স্বীয় গোষ্ঠীর জীবিত বা মৃত মানুষের মঙ্গল কামনা করা।
চীনের এই ভূত বিয়ের ঐতিহ্য প্রচলনের ক্ষেত্রেও তেমনই একটি উদ্দেশ্য ছিল। মৃত ব্যক্তির পরকালে সঙ্গীর ব্যবস্থার জন্যই নাকি এই ভূত বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। তারা মনে করতেন কোনো পুরুষ বা নারী যদি অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তাহলে পরকালে তাদের স্বামী কিংবা স্ত্রীর ব্যবস্থা থাকা উচিত।
মনে করা হতো যে, এতে করে মৃত পুরুষ কিংবা নারীর সঙ্গীর ব্যবস্থা হবে এবং তার পরিবারের জীবিত সদস্যদের মঙ্গল হবে। ভূত বিয়ের সর্বাধিক প্রচলিত রীতিই ছিল একজন মৃত পুরুষকে মৃত নারীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া। এক্ষেত্রেও জীবিত অবস্থায় তাদের বিয়ে ঠিক ছিল কিনা সেটা অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। মৃত অবিবাহিত পুরুষ বা নারীর পরকালে সঙ্গীর ব্যবস্থা করা ভূত বিয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকলেও শুধু এটিই যে একমাত্র কারণ, তা কিন্তু নয়।
তারা মনে করতেন কোনো পুরুষ বা নারী যদি অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তাহলে পরকালে তাদের স্বামী কিংবা স্ত্রীর ব্যবস্থা থাকা উচিত।
কিংবদন্তী অনুসারে জানা যায়, যদি কেও অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এবং যথাযথ ভূত বিয়ের ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে তার আত্মা পরিবারের জীবিত সদস্যদের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে। যথাযথ ভূত বিয়ের আয়োজন না করা পর্যন্ত সে নাকি থেকেই যায়। মৃত ব্যক্তির আত্মা তাদের পরিবারের সদস্যদের থাকার সময় তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যেও থাকে বলে তাদের বিশ্বাস ছিলো।
ভয়ংকর যে বিষয়
সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, ভূত বিয়ের জন্য অনেকে পাত্র-পাত্রী না পেয়ে কবরস্থান থেকে মৃতদেহ চুরি করে থাকেন। ২০১৫ সালে শানসি প্রদেশের একটি গ্রাম থেকে ১৪ জন নারীর মরদেহ চুরি হয় ভূত বিয়ের উদ্দেশ্যে। এসব মরদেহ চুরি করে চড়ামূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হয় ভূত বিয়ে প্রয়োজন এমন পরিবারে। ২০১৯ সালে হেনান প্রদেশের মরদেহ চুরি রোধ করতে কিছু কবরস্থানে সিসিটিভি ও কংক্রিটের কফিনের ব্যবস্থা করা হয়।
২০১৬ সালে মা চংখুয়া নামের এক ব্যক্তি দুজন মানসিক প্রতিবন্ধী নারীকে হত্যা করে তাদের মরদেহ ৮ হাজার ৩০০ ডলারে বিক্রি করে দেয় ভূত বিয়ের জন্য।
চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এই কুসংস্কারটি এতটাই গভীর হয়ে আছে যে প্রিয়জন হারানোর বেদনার চেয়ে মৃতের বিয়ে দেওয়াটাই সেখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
ইয়াং অয়াং নামের চীনের সাংশি হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যখনই হাসপাতালে কোনো অবিবাহিত তরুণী মারা যান, তৎক্ষণাৎ ভূত বিয়ের জন্য তার দেহ নিলামে উঠে যায়। মৃত ছেলেদের পরিবার নিলাম যুদ্ধে লেগে পড়ে মেয়েটিকে পেতে।’
বেশিরভাগ সময়েই মৃত্যুর প্রহর গুনছে এমন মেয়েদের শরীর বিক্রি করা হয় ভূত বিয়ের জন্য। অনেকে আবার এই মৃত মেয়েদের সন্ধান দিতে ঘটকালীও করে থাকেন।
যেভাবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হয়
সাধারণ বিয়ের মতই ‘ভূত বিয়ে’ পালন করা হয় উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে। সারাদিন অনুষ্ঠান ও কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে মৃত নারীর শরীরের হাড় পুরুষের কবরে দিয়ে দেওয়া হয়। যদিও দু’জনের আলাদা কবর দেওয়ার বিধান রয়েছে। এই হাড় কেনাবেচা নিয়েও প্রচুর ব্যবসা করে চীনারা।
সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা বিভাগের প্রধান হুয়াং জিংচুন জানান, কনের হাড়ের দাম অনেক বেশি বিশেষ করে যদি তারা অল্পবয়সী হয়। গবেষণা অনুসারে, হাড়গুলো ছেলের পরিবারকে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ইউয়ানে কিনতে হয়ে। এটি অনেক ক্ষেত্রে ১ লাখ ইউয়ান পর্যন্ত যেতে পারে৷
ভূত বিয়েতে মৃতদেহকেও জীবিতের মত করে সাজানো হয়। বিয়ের সময় মৃত নারীকে সাদা রঙের গাউন পরিয়ে সঙ্গে ভারী অলঙ্কার দিয়ে সুসজ্জিত করে দেওয়া হয়। বরকেও সাজানো হয় পরিপাটি করে। কাগজ ও বাঁশ দিয়ে বর-কনের পুতুল তৈরি করা হয়, সেই সঙ্গে আসবাবপত্র, খাবার এবং তাদের পরকালে কাজে লাগবে এমন সব খাবার তৈরি করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে কাগজের পুতুলসহ সবকিছু পুড়িয়ে ফেলা হয় এই বিশ্বাসে যে সেগুলো মরদেহের কাছে পৌঁছে যাবে।
৩ হাজার বছরের পুরনো প্রথা হলেও একবিংশ শতাব্দীতে চীনের কিছু পশ্চাৎপদ গ্রামে এখনো ভূত বিয়ের প্রথা চলমান। তবে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথাটির বেশকিছু অন্ধকার দিক রয়েছে। যা কেবল সেই স্থান বা প্রদেশে নয় বরং পুরো দেশকেই প্রভাবিত করছে।
১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া চীনের ‘এক সন্তান নীতি’ এবং কন্যা শিশুর ভ্রূণহত্যার কারণে এখনো সেদেশে মেয়েদের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কম। এর মধ্যে ভূত বিয়ে প্রথাটি মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আছে।
চীনের গ্রামাঞ্চলে হাজার হাজার তরুণ কয়লা খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। তারা প্রায়ই খনি দুর্ঘটনায় কম বয়সে অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান। এত মৃতদেহের জন্য মেয়ে খুঁজতে গিয়ে চীনের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০২
আপনার মতামত জানানঃ